বাংলার রূপ যে দেখেছে পৃথিবীর রূপ তার না দেখলেও ক্ষতি নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ, শ্যামল সবুজ আমাদের এই দেশের যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যেন চোখ আটকে যায়। প্রকৃতি তার আপন হাতে সাজিয়ে দিয়েছে এদেশের মাঠঘাট। মন জুড়ানো রূপে যেন চোখ ধাধানো, মনমাতানো সৌন্দর্যের আশীর্বাদপুষ্ট আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
তেমনি এক রূপ বৈচিত্রের অনন্য এক নান্দনিক মনোমুগ্ধকর স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। সুন্দরবনের পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনভুমি। জীববৈচিত্র্যের অনন্য এক সংগ্রহশালা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। যেন প্রকৃতির এক জীবন্ত জাদুঘর। মূলত জীব বৈচিত্র্যই এ বনের প্রধান আকর্ষণ।
বনে আপনাকে অভ্যথর্না জানাতে সদা প্রস্তুত নানা ধরনের বন্য প্রাণী আর কীটপতঙ্গ তাদের বিচিত্র সব সুর ও ধ্বনির মেলবন্ধনে অদ্ভুত সুন্দর তাল ও লয়ে। তবে সব সুর দিনের সব সময় পান কিংবা না পান ঝিঁ ঝিঁ পোকা তার সাইরেন বাজিয়ে আপনার কানে তালা ঝুলানোত আগ পর্যন্ত পিছু ছাড়বে না।
বনের ভিতরে হাটতে হাটতে আপনার চোখে পড়বে সারি সারি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক পুরনো গাছ, দেখে মনে হবে এরা যেন আকাশ ছোয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। এসব বৃক্ষ আবার তাদের বুকে নেমপ্লেট আঁটকে আপনাকে তার পরিচয় জানান দিবেসগৌরেব।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য
মুলত ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার এখানে বৃক্ষায়ন করলে তা বেড়ে গিয়ে আজকের এই বনের সৃষ্টি। মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতায় এই বন টির আয়তন ১২৫০ হেক্টর। চিরহরিৎ এই বনটিতে নিরক্ষীয় অঞ্চলের রেইন ফরেষ্ট এর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তাই লাউয়াছড়াকে দেশের বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট বনও বলা হয়ে থাকে। প্রায় সারা বছর এখানে বৃষ্টি হয়। পাহাড়ি মৃত্তিকা দিয়ে গঠিত উঁচু নিচু পাহাড় ঘেরা বনকে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করে।
বনের ভেতরে বয়ে চলেছে অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া যা লাউয়াছড়াকে করেছে সজীব আর প্রানবন্ত। দেশে যেখানে বন্য প্রাণী দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে সেখানে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এক আশার আলো। জীববৈচিত্র্য ভরপুর এই বনে সাধারণ গাছ গাছালি ছাড়াও রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দূর্লভ উদ্ভিদ ও প্রানী। ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী যার মধ্যে উল্লুকের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে লাউয়াছড়ায় রয়েছে মাত্র ৪৯ টি উল্লুক যা সংখ্যায় খুব ই নগন্য। এছাড়াও প্রায় ৮ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায় এই বনে। রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর,শিয়াল,মেছোবাঘ, বন্য কুকুর,এশীয় কালো ভাল্লুক,মায়া হরিণ উল্লেখযোগ্য। সরীসৃপদের মধ্যে অজগর ও হলুদ কচ্ছপ উল্লেখযোগ্য। এ উদ্যানে বন্য পাখিদের মধ্যে রয়েছে সবুজ ঘুঘু, বন মোরগ, তুরকিবাজ, সাদা ভ্রু, ধুসর সাত শৈলী, প্যাঁচা, ফিংগে, লেজকাটা টিয়ে, কালোবাজ, হীরামন, কালো মাথার বুলবুল, ধুমকল প্রভৃতি। আশার কথা হলো বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত প্রায় পাখি শকুনের নিরাপদ অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে লাউয়াছড়াকে।

বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কাজে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ইউএসএআইডি(USAID)-এর আর্থিক সহযোগিতায় নিসর্গ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। যা এই বনের পরিবেশের মান আরো উন্নত করে তুলেছে। এ প্রকল্পের আওতায় লাউয়াছড়া ভ্রমণের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট হারে মূল্য দিয়ে প্রশিক্ষিত গাইড দিয়ে বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা করা যায়।এই বনে রয়েছে ৩ টি ট্রেইল বা পাঁয়ে হাঁটার পথ যা আড়াই ঘন্টা থেকে তিন ঘন্টার পথ। ভিন্ন এই ট্রেইল গুলোতে ট্রেকিং করে খুব কাছ থেকে এই বনের রূপ উপভোগ করতে পারবেন। ট্রেকিং এর সহায়তার জন্যে আছে গাইড। চাইলে সাথে করে গাইড নিয়ে নিতে পারবেন। উঁচু নিচু টিলা ও গাছগাছালির ফাঁকে আলো আঁধারির চোখ ধাঁধানো খেলা, পাখির কিচিরমিচির, ঝিঁঝিঁ পোকার গান সব কিছু মিলিয়ে মুগ্ধতা ছড়ানো এক অদ্ভুত জাদুতে আপনাকে বিমোহিত করে রাখবে পুরো ঘুরে বেড়ানোর সময়টুকু।
খাসিয়াদের সঙ্গ
এছাড়া লাউয়াছড়ায় পায়ে হাঁটার পথের দুইপাশে রয়েছে লতা, গুল্ম ও বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। বর্ষাকালে জোঁকের উপদ্রব থাকে তাই সাবধানে হাঁটা উচিত। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে এই সুন্দর সবুজের সমারোহ উপভোগ করে নিতে পারেন আর শরীর ও মন কে দিতে পারেন অনাবিল প্রশান্তি। লাউয়াছড়ায় যে শুধুই প্রকৃতি এর সান্নিধ্য রয়েছে তা কিন্তু নয়। এখানে আসলে ঘুরে আসতে পারেন মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি। ১৯৫০ সাল থেকে খাসিয়ারা এখানে বসবাস করে আসছে। তবে এ পুঞ্জি তে ঘুরতে লাগবে বিশেষ পাস বা অনুমতি।
খাসিয়া বন আর উঁচু নিচু টিলার সমন্বয়ে গঠিত এই পুঞ্জি। টিলার গায়ে সুপারিগাছের কিংবা পানের বরজে লতিয়ে বেয়ে উঠেছে পান গাছ। লেবু ও আনারসের পাশাপাশি পান খাসিয়াদের আয়ের অন্যতম উৎস। খাসিয়াদের বর্নিল জীবনধারা, তাদের সংস্কৃতি আপনাকে আনন্দ দিবে। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে খাসিয়ারাও এই বনের দেখাশোনা করে।
চায়ের সাথে সখ্য
বনে বাঁদারে ঘুরেফিরে ক্লান্ত দেহকে কিছুটা স্বস্তি দিতে উঁচু টিলার উপরে রয়েছে টং দোকান। কোমল পানীয়সহ রয়েছে সাত রঙের চায়ের আয়োজন। এই চায়ের স্বাদ যা আপনার ক্লান্ত শরীরকে চনমনে করে তুলে কিছুটা আরাম দিয়ে আপনাকে রিচার্জ করে দিতে সাহায্য করবে। পাহাড়ের উপরের মিষ্টি বাতাসে জুড়াবে শরীর ও মন। প্রায় সারা বছরই এখানে পর্যটকের যাতায়াত থাকে, তবে শীতকালে অনেক বেশি পর্যটক সমাগম থাকে।

লাউয়াছড়ার বনের মাঝদিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন। রেললাইনের দুইপাশে গাছগাছালি। এই জায়গাটিও দর্শনার্থীদের কাছে খুব প্রিয়। রেললাইনের পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াতে পারেন। এছাড়া লাউয়াছড়া যাবার পথে চোখে পড়বে চা-বাগান, উচু-নিচু টিলা, আনারস, লিচু ও লেবু বাগান। রাস্তার দুপাশেই সবুজের ছড়াছড়ি, মনে হবে যেন সবুজের একটি স্বর্গরাজ্য।
আরও একটি চমৎকার বিষয়, এইখানে বিখ্যাত হলিউড মুভি ‘Around The world In Eighty Days’ এর শুটিংও হয়েছিল। এছাড়াও নন্দিত কথা সাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘আমার আছে জল’ এর শুটিং এর কিছুটা ও এখানে করা হয়েছিলো।
যাতায়াত
দেশের যে কোন জায়গা থেকেই এখানে আসা যায়। বাসে করে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল আসতে ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে ৪৭০- ৬০০ টাকায় শ্যমলী, এনা, হানিফ এন্টারপ্রাইজ কিংবা সিলেট এক্সপ্রেস এসি, নন এসি বাসে প্রায় ৪ ঘন্টায় চলে আসা যায়।
ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে আসতে পাহারিকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস এ সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল করে। ক্লাস অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৬৮৫ টাকায় চলে আসতে পারেন শ্রীমঙ্গলে। এখান থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী সিএনজি, জীপ,মাইক্রোবাস নিয়ে আসা যাওয়া যায় এক্ষেত্রে ভাড়া পরবে ৪০০ থেকে ৫০০।
মনে রাখা ভালো
যেভাবেই আসুন এখানে আসলে মেনে চলতে হবে কিছু সাবধানতা।
**যেখানে সেখানে ময়লা আর্বজনা ফেলবেন না।
**খুব বেশি হৈ চৈ করবেন না।
**পায়ে হাঁটার পথে জোক ও সাপের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
**অপরিচিত কারো সাথে একা একা বনের গভীরে প্রবেশ করবেন না।
**রেললাইন এ হাঁটার সময় ট্রেনের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।