রূপ সৌন্দর্যে ভরপুর আমার সোনার দেশ বাংলাদেশ, যার রূপের কোন শেষ নেই। পরিব্রাজক যেদিকেই যাবে সেদিকেই যেন চোখ আটকে যাবে এমন সবুজ শ্যামল আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ সিলেট সবুজের মায়া যেখানে পেতে দিয়েছে তার আঁচল। বিশাল আকাশের নিচে সবুজের ছাউনি। নিবিড় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় আমাদের মন। প্রশান্তি দেয় শরীরে। মন জুড়িয়ে দেয় দেয় তার নরম পেলব ছোয়ায়, পরিতৃপ্তি দেয় আমার মস্তিষ্ককে।
নতুন করে নিজেকে উপভোগ করতে প্রকৃতি যেখানে মেলে দিয়েছে নিজেকে, সেখান থেকে দূরে থাকা কেন?
মাধবকুন্ড এর পরেই আরেকটি ঝর্ণা বা জলপ্রপাত হাম হাম। এ জলপ্রপাত রচনা করেছে আরেক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ নিজের চোখে না দেখে যা উপভোগ করা যায় না।

হাম হাম ঝর্ণা-র নামকরণ
এ পর্যন্ত যদি ও কোন গবেষক দল হাম হাম এ কোন অভিযান পরিচালিত করেনি। তাই এ ঝর্ণার নামকরণ সম্পর্কে রয়েছে নানা অভিমত। হাম হাম- শব্দটা একটু অপরিচিত মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, এই জলপ্রপাত পরিচিতি পেয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি এবং এই শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন হাম্মাম বা গোসলখানা থেকে এই ঝর্ণার নাম হাম হাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন সিলেটি উপভাষায় আ-ম- আ-ম বলে বুঝানো হয় তীব্র পানির শব্দ। আর ঝর্ণাবযেহেতু এরকম শব্দ করে সেহেতু সেখান থেকেই শহুরে পর্যটকদের ভাষান্তরে তা হাম হাম নামে প্রসিদ্ধি পায়। তবে স্থানীয়দের ভাষায় এখানে এক সময় অনেক চিতা বাঘ পাওয়া যেত। তাই এই ঝর্ণা চিতা ঝর্ণা নামেও পরিচিত।
হাম হাম ঝর্ণার অবস্থান
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জেলা মৌলভীবাজার এর কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত কুরমা বিট বন এলাকার গভীরে অবস্থিত এ জলপ্রপাত। ২০১০ সালের শেষাংশে পর্যটক গাইড দেব বার্মা ও একদল পর্যটক এ ঝর্ণাটি আবিষ্কার করেন। আনুমানিক ১৪৭ ফুট মতান্তরে ১৭০ ফুট উঁচু এই ঝর্ণাটি মাধবকুণ্ড থেকেও প্রায় তিন গুন বড়।
যদিও সরকারিভাবে এখনও এর কোন স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। হাম হাম এর দূরত্ব চাম্পারায় চা বাগান হতে ৭ কিমি। এ ঝর্ণার সৌন্দর্য যেমন চোখ ও মনের প্রশান্তি দেবে তেমনি তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে ও ঘাম ঝড়াতে হবে প্রচুর। পাড়ি দিতে হবে দূর্গম কঠিন পাহাড়ি গিরিপথ। আর এ গিরিপথের মাঝে হঠাৎ ই চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার আশংকাও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে জোক, পোকা ও সাপের ভয়। তাই সাবধানে এগিয়ে যেতে হবে। যেহেতু সরকারি ভাবে এখন ও কোন দিক নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি তাই এ এ ছাড়া কোন উপায় ও নেই। এ কঠিন পথ পেরিয়েই দেখা মিলবে অপূর্ব, দৃষ্টিনন্দন হাম হাম নামক জলপরীর প্রবল গতিবেগে আছড়ে পরা বিপুল জলরাশি।
রাস্তায় সবথেকে উঁচু এবং খাঁড়া যে পাহাড় তার নাম মোকাম টিলা। এটি অতিক্রম করা একটু কষ্টসাধ্য বটে! তবে মন খারাপ করতে হবে না। এর পাশের পাথুরে প্রাচীরগুলো দেখলে আপনার মন ভালো হতে বাধ্য! এই মোকাম টিলার পাশেই আরেকটি ছোট ঝর্না আছে যা স্থানীয়ভাবে ‘সীতাব’ নামে পরিচিত। অপরূপ এই ঝর্ণাটি দেখতে ভুলবেন না। বর্ষাকালে হাম হামে যাওয়ার পথে দেখা মিলবে অনুচ্চ আরো একটি ছোট ঝর্ণার। হাম হামে রয়েছে দুটো ধাপ। সর্বোচ্চ ধাপ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে মাঝখানের ধাপে।বআর মাঝখানের ধাপ থেকে গড়িয়ে পরে অগভীর খাদে।

হাম হামে কখন আসবেন?
ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগের উত্তম সময় বর্ষাকাল। বলা হয়ে থাকে বর্ষা হলো ঝর্ণার যৌবনকাল। শীতকালে যা অনেক স্থিমিত হয়ে আসে। সরকারি ভাবে এ ঝর্ণায় পৌছাতে এখনও কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয় জনগণ বা স্থানীয় গাইডের সহযোগিতায় যেতে হয় হাম হাম জলপ্রপাতে।
হাম হামে যাবার পথে দেখা মিলবে রাজকান্দি বনাঞ্চল। সারি সারিকলা গাছ, জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের সমাহার। রয়েছে দলু, মুলি, মির্তিঙা, কালি ইত্যাদি নামের বিচিত্র সব বাঁশ। বিভিন্ন বূনো গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙ বেরঙের প্রজাপতির উড়োউড়ি আপনার মনকে অন্যরকম এক ভালোলাগায় ভরিয়ে দেবে। ভাগ্য ভালো হলে চলার পথে ডুমুর গাছের শাখা, আর বেত বনের ফাঁকে চশমা পড়া হনুমান ভেংচি কেটে দিয়ে যাবে। যদিও দূর্গম কিন্তু এই হাম হাম তার সৌন্দর্য দিয়ে আপনার সেই ক্লান্তি আর কষ্ট কে নিমিষেই ভুলিয়ে দিবে। এই ঝর্ণায় ভ্রমণ কালে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন পানি ও খাবার নিয়ে যাওয়া ই বুদ্ধিমানের কাজ।
অনিন্দ্য সুন্দর এই ঝর্ণায় প্রায় ই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। শীতল এই জলপ্রপাত এর স্বচ্ছ জলরাশি আপনার মনে ছড়িয়ে দিবে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। শুধু হাম হাম এর শীতলতা ই নয়, এ ঝর্ণার কাছাকাছি ত্রিপুরা আদিবাসীদের বসবাস। আপনি চাইলে এই আদিবাসীদের সাথে ও কাঁটাতে পারেন কিছুটা সময়।
যোগাযোগ
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যায় এই জলপ্রপাত এর কাছে। বাস, ট্রেন বা বিমান যেভাবেই যান না কেন, প্রথমে আপনাকে যেতে হবে শ্রীমঙ্গলে। ঢাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ ও এনা পরিবহনের বাস সরাসরি শ্রীমঙ্গল যায়। ভাড়া পড়বে ৩৮০-৪০০ টাকা। এছাড়া ঢাকা-সিলেট এর মধ্যে চলাচলকারী যেকোনো আন্তনগর ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া দিতে হবে ১৭৫-৩৫০ টাকা। আর বিমানে যেতে চাইলে সরাসরি সিলেটে চলে যেতে হবে।তারপর সেখান থেকে শ্রীমঙ্গলে আসতে হবে।
শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ী ভাড়া করে সরাসরি কলাবনপাড়া চলে যাওয়া যাবে। যে গাড়িতে যাবেন, সেটি অবশ্যই যাওয়া ও আসার জন্য ভাড়া করবেন। কারণ ঐ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না। তাই শুধুমাত্র যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করলে আসার সময় যথেষ্ট সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সিএনজি নিয়ে গেলে ভাড়া ১২০০-১৮০০ টাকার মধ্যে হবে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কলাবনপাড়া যেতে দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। অন্যদিকে কলাবনপাড়া থেকে হামহামে যেতে-আসতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। রাস্তা খারাপ হলে একটু বেশী লাগতে পারে। তাই শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সকাল সাড়ে ছয়টার ভেতরে রওয়ানা হওয়াই ভাল।
মনে রাখা আবশ্যক
**ট্রেকিং এর জন্য ভালো গ্রীপের জুতো ব্যবহার করবেন।
**ব্যাকপ্যাক যত সম্ভব হাল্কা রাখুন।
** সাথে পানি ও খাবার স্যলাইন রাখুন।
**পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ চলার সময় সাবধান থাকবেন।
** ফার্স্ট এইড বক্স সাথে রাখবেন।
** ঝর্ণা ও ট্রেইলে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।
**স্থানীয়দের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আঁচরণ করুন।
** সন্ধ্যা হবার আগেই ফিরে আসুন।
**সাথে করে কিছু লবণ এবং সরিষার তেল নিয়ে যান।
যে কোন ভ্রমণে কষ্ট থাকলে ও আনন্দের মাত্রাটা তার চেয়ে অনেক গুন বেশি।
যে কোন পর্যটন স্থান আমাদের সম্পদ, আমাদের দেশের সম্পদ। এইসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করুন। দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের।
নিজের দেশকে জানুন, নিজেকে ও নিজের আত্মাকে পরিতৃপ্তি দিন