২৭ মার্চ শহীদ কবি মেহেরুননেসা, তাঁর শ্রদ্ধেয় মা ও সহোদর দু’ভাইয়ের একান্নতম মৃত্যুবার্ষিকী।
একাত্তরের এদিন অবিশ্বাস্য পৈশাচিকতার শিকারে পরিণত হবার সময় মানুষটি’র বয়স ছিল মাত্র ২৯, জীবনের সূচনাতেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল মা ও ভাই’দের নিয়ে। জীবন সংগ্রামে তিনি জয়ীই ছিলেন, সে যুদ্ধে তিনি অপরাজেয়। বাবা’র মৃত্যু’র পর পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর ওপরেই এসেছিল।
১৪ বছর বয়সে, প্রজাপতির মতো জীবন হবার কথা যার। তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল কঠিন জীবন যুদ্ধে। বাংলা একাডেমী, ইউসিস লাইব্রেরী’তে কপি রাইটার হিসেবে কঠোর শ্রম দিয়েছেন। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এক অনন্য দেশপ্রেমিক, স্বজাত্যবোধে অনুপ্রাণিত এক মহান মানুষ। তাঁর নাম মেহেরুননেসা।
শহীদ কবি মেহেরুননেসা
১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট, কোলকাতার খিদিরপুরের পাইপ রোডের ৬৩/১ বাড়িতে জন্মেছিলেন। তাঁর শৈশব কেটেছে কোলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে। ছোটবেলা থেকেই,পৃথিবীর প্রতি আগ্রহ প্রবল ছিল, যার প্রমাণ পরবর্তীতে আমরা দেখি তাঁর কাব্য প্রতিভায়। বাবার সঙ্গে যে ছোট্ট মেয়েটি কয়লার দোকানে বসতেন, সে মেয়েটিকেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়ে পরিবারের সবার সাথে ১৯৫০ সালে ঢাকা চলে আসতে হয়। পুরোন ঢাকার নানান এলাকায় বাস করে ১৯৬৫ সাল নাগাদ তাঁদের পরিবার থিতু হয়ছিলেন মিরপুরে। সেসময় মিরপুর বিহারী অধ্যুষিত এলাকা, বাঙালী পরিবার বিহারীদের তুলনায় নগণ্য।
আমাদের অনেকেরই জানা নেই, ‘আমাদের দাবী মানতে হবে’ এবং ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দুটি কবি মেহেরুননেসার সৃষ্টি। ১৯৫৪ সালে তাঁর রচিত কবিতা ‘রাজবন্দী’তে এ লাইন দুটি এসেছে।
নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার পথে
বাবা’কে হারিয়েছিলেন ক্যান্সারে। এরপর, জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে তিনি ফিলিপস ওয়ার্কশপে রেডিও মেরামতের কাজও করেছেন।এখানে অবশ্য উল্লেখ্য যে, সে সময় ফিলিপস ইংরেজি ও উর্দু’তে মুখপত্র ছাপাতো, কবি মেহেরুননেসা’র চেষ্টায় বাংলা ভাষায় রচিত পত্রিকাও প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল ফিলিপস কর্তৃপক্ষ।
কবিতার প্রতি ভালোবাসা, বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ তাঁকে সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে থাকতে দেয়নি। তাঁর সৃষ্টি ছাপা হয়েছে, ইত্তেফাক, বেগম, দৈনিক পাকিস্তান, যুগের দাবী সহ অনেক কাগজ ও সংকলনে। তাঁর ‘রানু আপা’ ছদ্মনামে লেখা রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলো ৬৯’এর আইয়ুব বিরোধী উত্তাল গণআন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দিতো। আর এসব গণমুখী লেখনী তাঁকে সকলে প্রিয় রানু আপা বানিয়ে দিয়েছিলো।
কবি মেহেরুননেসা শুধুমাত্র রাজনীতি সচেতন মানুষই ছিলেন না, আমরা তাঁর মাঝে প্রবল সমাজবোধের প্রকাশ দেখতে পাই নীচের পঙক্তিতে।
‘কয়লা খনির গভীরে দেখেছি জ্বলতে
জ্বালানীবিহীন মহাজীবনের সলতে
তবুও কখনো শুনিনি ওদের বলতে
আমরাও জানি জীবন নাট্য ঘরে
বাঁচার খেলা খেলতে………’
বিপ্লবের সারথি
২৩ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ তারিখে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির কর্তৃক আয়োজিত বিপ্লবী কবিতা পাঠের আসরে খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবিরসহ অন্যান্য কবিদের সঙ্গে কবিতাপাঠে অংশ নেন মেহেরুননেসা। যেখানে তিনি তাঁর নিজের লেখা “জনতা জেগেছে” নামের কবিতাটি পাঠ করে সবাইকে উজ্জীবিত করে ফেলেন। ড. আহমদ শরীফ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে সবাই তার কবিতার প্রশংসা করেন এবং এদিনই কবিতাটি ‘বেগম’ পত্রিকায় একই নামে প্রকাশিত হয়।
কবি মেহেরুন্নেসা ও তাঁর দুই ভাই মিরপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য রফিক ও টুটুল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মিরপুরে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। মিরপুর তখন বিহারী অধ্যুষিত একটি এলাকা হিসেবে পরিচিত, বলা যায় ওই এলাকায় বাঙ্গালিরা সংখ্যালঘু ছিলো, সেখানেও কব ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রথম থেকেই চিহ্নিত মুক্তিকামী বাঙালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
অবশেষে ২৭শে মার্চ এলো, দু’দিন আগেই ঢাকা’সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন একতরফা গণহত্যা শুরু হয়ে গিয়েছে। মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লক, ১২ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িতে সেদিন সংঘটিত হয়েছিল অমানবিক, পৈশাচিক, নির্মম হত্যাযজ্ঞ।

খোদার আরশ কি কেঁপেছিল সেই ক্ষণে ?
বেলা আনুমানিক ১১ টা থেকে ১২ টার ভেতর এ বাড়িতে হানা দেয়, মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুর এলাকার একদল বিহারী অমানুষদের সাথে নিয়ে কবি মেহেরুননেসার বাড়িতে আক্রমণ করে এবং বাড়িতে প্রবেশ করে। কুখ্যাত কাদের মোল্লার সাথে হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, কুখ্যাত আখতার গুন্ডা ও নেহাল গুন্ডা সহ আরও বেশ কিছু বিহারী অমানুষ ছিলো যারা পাশবিকতার চরম সীমা অতিক্রম করেছিল সেদিন কবি ও তার পরিবারের সাথে।
দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে কবি মেহেরুননেসা বুকে কোরআন শরিফ চেপে বলেছিলেন , ‘আমরা তো মুসলমান আমাদের মারবে কেন? যদি মারতেই হয় আমাকে মারো। ওদের কোনো দোষ নেই। ওদের ছেড়ে দাও।’ কিন্তু পাকিস্তানী ও তাদের এ দেশীয় দালাল হাইওয়ান’দের ভেতর কোন মনুষ্যত্ব ছিলোনা একাত্তরে, আজও নেই।
প্রথমেই কবি মেহেরুননেসার দুই ভাই রফিকুল ইসলাম বাবলু ও শহিদুল ইসলাম টুটুল’কে মেরে ফেলে জল্লাদের দল। প্রত্যক্ষদর্শী এক বিহারী’র (হত্যায় অংশ নেয়নি এবং সে ছিল প্রতিবেশী) তথ্যে জানা যায় তাঁর দুই ভাইয়ের মাথা বিচ্ছিন্ন করে লাথি মারা হয়। কবি’র মা ছেলেদের মৃত্যু দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁকে সে অবস্থাতেই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খণ্ড খণ্ড করে কাটা হয়। সবাইকে হত্যা শেষে কসাই কাদের ও আখতার গুন্ডা (প্রত্যক্ষদর্শী সেই বিহারীর ভাষ্যমতে) কবি মেহেরুননেসার মাথা বিচ্ছিন্ন করে, তাঁর লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। তাঁর পবিত্র রক্ত সেদিন পুরো কক্ষ জুড়ে ছিটকে পরেছিল।
সূর্যজ্যোতির পাখি
কবি তাঁর স্বপ্নের গ্রন্থটির নাম রেখেছিলেন, ‘সূর্যজ্যোতির পাখি’। তিল তিল করে নিজের দেখা ও অভিজ্ঞতায় অর্জিত সঞ্চয় তিনি লিখে প্রকাশ করবেন বলে লিখতে থাকেন ‘সূর্যজ্যোতির পাখি’ গ্রন্থটি যা আর প্রকাশিত হয়নি, তাঁর সৃষ্টিকর্মের আলোয় উদ্ভাসিত হবার আগেই নির্মম মৃত্যু এসে কেড়ে নেয় তার জীবনের আলো, সাথে তার পরিবারের সদস্যদের জীবন প্রদীপের সলতেও ফুরিয়ে যায় নিষ্ঠুর অমানুষ কাদের মোল্লা গংদের পাশবিকতার কারণে।
(বি: দ্র: তার হাতে লেখা ‘সূর্য জ্যোতির পাখি’র পান্ডুলিপির মূল কপি এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে)
গেরিলা ১৯৭১, শহীদ মেহেরুননেসা এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে স্মরণ করি গভীর বেদনায়, হৃদয়ের রক্তক্ষরন নিয়ে। তাঁর ও পরিবারের সকলের চিরশান্তি প্রার্থনা করি।
‘লানত’ বর্ষিত হোক কসাই কাদের, আখতার গুন্ডা, আব্বাস চেয়ারম্যান, নেহাল গুন্ডাসহ সব খুনি, ধর্ষক, লুঠেরা বিহারীদের ওপর। পৃথিবীর সবটুকু লানত পরুক এদের ওপর, এদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। বংশ পরম্পরায় এই লানত তারা বয়ে বেড়াক।