মহাবিশ্বে ঘটা প্রতিটি ঘটনার শুরুটা যেমন নির্ধারিত তারচেয়েও বেশি নিয়তি নির্ধারিত হলো সেই ঘটনা কিংবা পরিব্যপ্তির নিশ্চিত সমাপ্তি। ২০০৭ সালে রিকার্ডো কাকার হাত হয়ে যখন পরের বছর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাতে ব্যালন ডি’অর আসলো তখন কেউ কি ভুলেও ধারণা করতে পেরেছিলো যে ফুটবলের সবচেয়ে লাস্যময়ী এই পুরস্কার দশকেরও বেশি সময় জুড়ে শুধু মেসি ও রোনালদোর দ্বৈরথ মাখানো হাতেই আসা-যাওয়া করবে? শুধু তা-ই নয়, একটা সময় তামাম ক্রীড়ামোদী আমজনতার প্রশ্ন ছিলো কবে ভাঙবে এই দ্বৈরথ? আদৌ কি কেউ আছে যে তাদের খেলোয়াড়ি জীবনেই এই পুরস্কার তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী কাজটির ইতিহাস লিখে নিতে পারবে? তবে এটা ঠিক, কেউ না কেউ তাদের জায়গা দখল করবে যেমন সত্য, তেমনি তারা বুটজোড়া জমা দেয়ার আগেই কেউ ব্যালন ডি’অর বগলদাবা করবে সেই ভাবনা ভাবার লোকের সংখ্যাও যে অতি নগন্য ছিলো সেটাও সত্যি। কিন্তু সময় বড্ড বেরহম হয়ে যায় কখনো কখনো, কিংবা বলা চলে সময় তার নিজের প্রয়োজনেই আপন বলয় ভেঙে একসময় নতুন কক্ষপথ তৈরি করে নেয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, এটাই প্রকৃতির মহিমা।
আর প্রকৃতির সেই খেয়ালি বেখেয়ালে মেসি রোনালদোকে পাশ কাটিয়ে যিনি ব্যালন ডি’অর নিজের দখলে নিয়েছিলেন তিনি ক্রোয়াট অধিনায়ক ও রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো লুকা মডরিচ। অথচ সবাই ধরে নিয়েছিলো একটা সময় যখন মেসি আর রোনালদো অবসরে যাবে তখন ব্যালন ডি’অর যদি জিতে তবে সে হবে নেইমার, বেনজেমা, গ্রিজমান, এমবাপে, কেভিন ডি ব্রুইন, এডেন হ্যাজার্ড, গ্যারেথ বেল কিংবা অন্য কেউ। কিন্তু কেউ ভাবে নি এটা লুকা মদ্রিচ নামের কারো হাতে উঠবে, তাও আবার মেসি-রোনালদোর প্রথা ভেঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার জাদারে জন্ম নেওয়া ৩৩ বছর বয়সী একজন সেন্টার মিডফিল্ডার এটা জিতে নিবে তা কেউ ভেবেছিলো?
লুকা মদ্রিচ এর পথচলা শুরু
ডায়নামো জাগরেবে এক মৌসুমে নিজেকে প্রমাণ করে সেখান থেকে টটেনহাম হটস্পার, স্পার্সের হয়ে আলো ছড়িয়ে সোজা রিয়াল মাদ্রিদ। ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয়। ক্রোয়েশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা থেকে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনাল ও আসরের সেরা খেলোয়াড় হওয়া। এক বছরে সকল সেরার অর্জন। খুব সহজ আর মসৃণ মনে হচ্ছে না এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া? মনে হলেও দোষের কিছু নেই, কিন্তু এই মনে হবার আড়ালে যে স্বল্পভাষী এই মধ্যমাঠ শিল্পীর কর দীর্ঘশ্বাস আর যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে তা কেবল আমাদের লুকিতা-ই জানে।
ক্রোয়েশিয়ার ছোট্ট শহর জাদারে জন্ম নেয়া লুকা মদ্রিচের বাল্যকাল কাটে ভয়াবহ এক যুদ্ধংদেহী পরিবেশের মধ্য দিয়ে। ১৯৯১ যুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গনের ফলে বলকান অঞ্চলে যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো সেই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই লুকা মদ্রিচের বেড়ে উঠা। সহিংসতা এবং ভয়ের মাঝে এক ভয়াবহ শিশুকাল কাটাতে হয়েছে তাকে। জাদারের রাস্তায় ফুটবল নিয়ে খেলতে গিয়ে শহরের অন্য আর দশটা শিশুর মতো মদ্রিচকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হতো কখন যে সার্বিয়ান বিমান থেকে বোমা বর্ষণ হয়। আকাশে বিমানের শব্দ পেলেই জীবন হাতে দৌড়ে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হতো। যদিও নিরাপদ আশ্রয় বলতে কিছুই ছিলো না। কারণ সার্বিয়ান সৈন্যরা তাদের বাড়িটাও বোমার আঘাতে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সার্ব সৈনিকদের হাতে মদ্রিচের দাদাও নির্মমভাবে নিহত হন। মদ্রিচের দাদার সাথে তাকেও আটক করেছিলো সার্বিয়ান সৈনিকেরা। মদ্রিচকে তারা ছেড়ে দিলেও তার দাদাকে তারা হত্যা করে, গৃহযুদ্ধের বলী হন তার দাদা।
যদিও যুদ্ধকালীন সময়টাকে আর ফিরে পেতে চান না লুকিতা, তবে ওই সময়টাকে একবারে ভুলেও যেতে চান না তিনি। তার ভাষ্যে, যুদ্ধ তাকে শক্তিশালী করেছে, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যুদ্ধ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আর নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে তোলার উদ্দীপনা তো সেই সময়েই শিখেছেন স্বল্পভাষী এই মাঝমাঠ শিল্পী।
নিজদেশের ক্লাব এনকে জাদারের বয়সভিত্তিক দলে ফুটবল খেলতে খেলতেই একসময় পরিচয় হয় তোমিস্লাভ বাসিচের সাথে। যে বাসিচের পরামর্শেই ক্রোয়েশিয়ার আরেক ক্লাব হাদজুক স্পিল্টের সাথে চুক্তি না করে জাদারেই থেকে যান আরো কিছু সময়। পরবর্তীতে এই বাসিচের মধ্যস্থতায় ডায়নামো জাগরেবের সাথে মদ্রিচের চুক্তি চুক্তি হয়। ১৫ বছর বয়সী মদরিচ ডায়নামো জাগরেবে ১০ বছরের চুক্তিতে যুবদলে যোগ দেয় যা তার ক্যারিয়ারের একটা সুন্দর রূপ পরিগ্রহ করতে ব্যাপকভাবে ভূমিকা পালন করে। কেননা এই ক্লাবের হয়ে তরুণ মদ্রিচ নিজেকে প্রমাণ করার মাধ্যমেই চোখে পড়েন ইউরোপের জায়ান্ট ক্লাবগুলোর। সেখান থেকেই তার টটেনহাম যাত্রা, আর স্পারদের হয়ে মেলে ধরেন নিজের প্রতিভার আকাশ।
টটেনহাম হটস্পার ও লুকা মদ্রিচ
টটেনহামের রবি কিন লিভারপুলে এবং দিমিতার বারবাতোভ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমালে তাদের শূন্যতা পূরণের জন্য ২০০৮ সালে ডায়নামো জাগরেবে দারুণ নৈপুণ্য দেখানো তরুণ মদ্রিচকে দলে ভেড়ায় টটেনহাম।
তবে টটেনহামের শুরুটা খুবই কষ্টের ছিলো লুকিতার। স্পার্স ম্যানেজার হুয়ান্দে রামোসের সময়কালে দলেজায়গা পেতে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়। বেঞ্চে বসতে বসতে মনোবল একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল বলা যায়। ২৩ বছর বয়সী মদ্রিচ দলে জায়গা পেতে একরকম যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন বলা যায়। তবে লীগে টানা ৬ ম্যাচ আর চ্যাম্পিয়নস লীগের গ্রুপ পর্ব হতে বিদায়ের জের ধরে হুয়ান্দে রামোস বরখাস্ত হয়ে হ্যারি রেডন্যাপের আগমনে মদ্রিচের আশার পালে হাওয়া লাগে।
হ্যারি রেডন্যাপ যেখানে জহুরি
তরুণ বয়সী যেকোনো খেলোয়াড়ের প্রতিভার সাথে দক্ষতার মিশেলে পরিস্ফুটিত হতে চাইলে একজন যথাযথ কোচের খুবই প্রয়োজন, আর ঠিক তেমন করেই যেন হ্যারি রেডন্যাপ তরুন মদ্রিচের জন্য একজন যথার্থ কোচ কাম মেন্টর হয়ে আসলেন।
হ্যারি রেডন্যাপ মদ্রিচের জীবনে তেমন একজন কোচ, যিনি জুয়ান্দ্রো রামোসের সময়কালের হতাশা দূর করে দিয়ে মদ্রিচের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তার সময়কালে মদ্রিচ তার প্রিয় ভূমিকায় খেলার স্বাধীনতা পেলেন। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মধ্যমাঠের একটু নিচের দিকে খেলার সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে কিন্তু হুয়ান্দে রামোসের সময়ে সেই সুযোগ না পেলেও নতুন কোচ এসে তাকে সেই জায়গায় খেলার স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন আর মদ্রিচও দারুণভাবে খুঁজে পেতে লাগলেন হারিয়ে যাওয়া নিজেকে। নিজের সেরা ফর্মে ফেরা মদ্রিচের উপর ভর করে ধুকতে থাকা টটেনহামও নিজেদের লীগের টেবিল টপার হিসেবে পাকাপোক্ত করে নিতে থাকে। যার ফল হিসেবে ২০০৮/০৯ মৌসুমে টটেনহাম হটস্পার প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের উল্লাসে মেতে উঠে। সেই মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাজয়ী হ্যারি রেডন্যাপের দলে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন এই লুকা মদ্রিচ। সেই মৌসুমে স্পার্সের মধ্যমাঠ যেন নিজের পায়ের তুলিতে রাঙিয়ে তুলেছিলেন।
নিজের ক্যারিয়ারে শৈল্পিক পালাবদলের পেছনে নতুন কোচ আর দলের রোল পরিবর্তনের প্রভাব মদ্রিচ স্বীকার করেছেন, তিনি একটি সাক্ষাৎকারে এটা উল্লেখ করে বলেন,” মাঠে আমার এই পজিশন পরিবর্তন আমার ক্যারিয়ারকে সামনে এগিয়ে নিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। এমনিতেই আমি মাঠের আরও গভীরে খেলতে পছন্দ করতাম, আর হ্যারি আমাকে সেই পছন্দের জায়গায় স্বাধীনভাবে খেলতে দেয়ায় আমার নিজেকে মাঠে নিংড়ে দেওয়ার আনন্দটা খুঁজে পাই আর সেটা চমৎকারভাবে আমি উপভোগও করতাম।” স্ট্যান্ডার্ড স্পোর্টসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রশ্নকর্তা সেইদিনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিতেই মদ্রিচ নিজের অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন,” যখন আমাকে আরও নিচে খেলতে পারার সুযোগ দেয়া হলো, তখন পিচে আমার ম্যাচ রিডিং এবিলিটিও যেন অনেকটা বেড়ে গেলো, আমি তখন মাঠে আমার প্রতিভাও ব্যবহার করতে পেরেছি সফলভাবে। রেডন্যাপই আমাকে বদলে দিয়েছিলেন, এজন্য আমি উনার কাছে কৃতজ্ঞ।”
অবশ্য রেডন্যাপের সময়ে মদ্রিচ অন্য পজিশনেও খেলেছেন তবে আশ্চর্যজনকভাবে, মদ্রিচ সেসব পজিশনেও তখন খুব একটা খারাপ খেলেননি। সম্ভবত এটাই ভালো কোচের একটা গুণ, যে তিনি তার খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারেন।
সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ও মদ্রিচের কিংবদন্তী হয়ে উঠা
স্পার্সদের হয়ে টানা চার মৌসুমে নিজের ফুটবল দক্ষতা প্রদর্শনীর মাধ্যমে নিজেকে অনেক ক্লাবের কাছেই আরাধ্য বানিয়ে নিলেও দাও মারে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরোতে ২০১২ সালে এই ক্রোয়াট মিডফিল্ডারকে কিনে নেয় মাদ্রিদের এই শতাব্দী শ্রেষ্ঠ ক্লাবটি। সে সময়ে এই অর্থের বিনিময়ে দল-বদল বিশাল কিছুই ছিলো। মজার ব্যাপার হলো, এই বিশাল অর্থের বিনিময়ে লুকা মদ্রিচ মাদ্রিদে এসে নিজের প্রথম মৌসুমের বেশ অনেকটা সময় লস ব্লাঙ্কোসদের হয়ে খেললেও বছর শেষে মার্কার মতে, তিনি নির্বাচিত হলেন সেই বছরে লা লিগায় সবথেকে বাজে সাইনিং হিসেবে।
অনেকটা টটেনহামের প্রথম মৌসুমের মতোই সংগ্রামের একটা সিজন পার করেছেন এখানে বলা যায়। পার্থক্য হলো নিজের প্রথম সিজনে টটেনহামের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেতেন কম আর মাদ্রিদে সুযোগ পেয়েও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। অবশ্য নতুন দেশে, নতুন ক্লাবে, নতুন সতীর্থদের পাশে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। তবে মাদ্রিদের সমর্থকেরা এটা মানবে কেন? সম্ভবত মার্কার খাতায় তাকে বাতিল দেখানোটাই মদ্রিচের আঁতে ঘা দেয়। আর তাই তো পরের মৌসুম থেকেই যেন নিজের স্বরূপে ফিরতে শুরু করলেন। সেটাও করলেন খুব দ্রুতই, ব্যর্থ একটা মোসুমের পরেই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমে তার বদল হতে থাকে। খুব দ্রুত তার পারফর্মেন্স খারাপ থেকে ভালো এবং ভালো থেকে অতুলনীয়ের দিকে ধাবিত হয়। কাকা, ওজিলদের ভীড়ে নিজেকে মাঝমাঠে প্রতিষ্ঠিত করে নেন ঠিকই। বিশেষ করে মাদ্রিদে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে মদ্রিচ দ্বিতীয়ার্ধে বেঞ্চ থেকে নেমে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে ভলি থেকে ম্যাচে সমতা ফেরানো যে গোলটি করেন তাতেই তিনি মাদ্রিদ সমর্থকদের মনে ভালবাসার জায়গা করে নেন। যদিও সেমিফাইনালে মাদ্রিদ সেই সিজনে লেফান্ডভস্কি নামক এক পোলিশ দানবের তান্ডবে সেমিফাইনালেই থেমে যায় তবে মদ্রিচ যেন নিজের সিগনেচার এঁকে দিয়ে জানিয়ে দেন তিনি বাতিল হতে নয়, দলকে অনেককিছু দিতেই সফেদ জার্সিটা গায়ে চাপিয়েছেন। আর পরের সিজনে স্বপ্নের লা ডেসিমা জয়ের পথে নিজেকে মধ্যমাঠের কান্ডারী প্রমান করে বনে যান মাদ্রিদের মধ্যমাঠ সুপারস্টার।
চ্যাম্পিয়ন্স লীগে মদ্রিচ ও মাদ্রিদ
গত দশকে চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড গড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। এই অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়তে কার অবদান সবথেকে বেশি বলে মনে করেন? সবাই হয়তো কিছু না ভেবেই জিনেদিন জিদান আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরবনাম স্মরণ করবে। জিদান কোচের দায়িত্ব নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ দলটাকে যেন বদলে দিয়েছিলেন। আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো! যিনি একাদশে থাকা মানেই হলো প্রতিপক্ষকে মানসিক শক্তিতে আগেই হারিয়ে দেবার সুবিধা পাওয়া। আর দলকে তিনি কী দিয়ে গেছেন তা না হয় উহ্য থাকুক। এই দুইজনের পরে যদি আপনাকে তৃতীয় কারো নাম নিতে বলা হয় তবে খেলা দেখে থাকলে আপনি কোনো আলোচনা ছাড়া আসবে লুকা মদ্রিচের নাম নাম নিতে বাধ্য হবেন, যে কিনা লীগ ও চ্যাম্পিয়নস লীগে মাদ্রিদের মধ্যমাঠে নিজের পায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন দক্ষতা আর প্রতিভার আশ্চর্যজনক মিশেলে।
প্রচন্ড চাপের মাঝেও মদ্রিচ যেভাবে মধ্যমাঠকে শাসন করতেন, তা বর্তমান সময়ের ফুটবলারদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। বয়স বিবেচনায় তিরিশের মধ্যগগনে এসেও তার ক্ষিপ্রতা একবিন্দু কমেনি বরং তার খেলায় শিল্প মান বেড়েই চলছে যেন। জার্মান স্নাইপার টনি ক্রুসকে মাঝমাঠের একটু উপরে উঠিয়ে দিয়ে নিজে নিচে নেমে খেলেন। সেখান থেকে যেন খোলা তলোয়ার পায়ে নিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থামিয়ে দিয়ে আবার অনেকটা তীরন্দাজের মতো নিখুঁত নিশানায় বল সঠিক যায়গায় পাঠিয়ে আক্রমণ গড়ে দিতে সিদ্ধহস্ত যোদ্ধা যেন। তার এই মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে ফুটে উঠেছিলো গত ২০১৭/১৮ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। ঠান্ডা মাথায় মধ্যমাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দু’দলের মাঝমাঠের যুদ্ধে একক বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি।
কেবলমাত্র মিডফিল্ডার হবার কারণে কিংবা দলে একটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামক দানব থাকার কারণেই হয়তো রিয়াল মাদ্রিদে জিদানের অধীনে যে তিন মৌসুমে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়েছেন তাতে তার আরও বেশি সম্মান ও স্বীকৃতি তার প্রাপ্য ছিল।
এবং রাশিয়া বিশ্বকাপ
ক্রোয়েশিয়ার জার্সি গায়ে মদ্রিচ খেলেছেন শতাধিক ম্যাচ খেলা মদ্রিচ গত রাশিয়া বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন দলের অধিনায়ক ও প্রত্যাশার বাহক হয়ে। একটি সম্ভাবনাময় দল নিয়ে মদ্রিচ রাশিয়া বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন ভালো কিছুর প্রত্যাশায়। প্রত্যাশার থার্মোমিটারের পারদ যদিও খুব বেশি উপরে ছিলো না, তবে তার মনে হয়তো তাদের অতীত সাফল্যকে অতিক্রম করার স্বপ্নটা পুষে রেখেছিলেন কি না কে জানে। ক্রোয়াটদের ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্য অর্জন করে নিলেন দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলে। যদিও বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে নেয়া হয় নি, তবে টুর্নামেন্ট জুড়ে ক্রোয়েশিয়া যেমন দারুণ খেলেছে তেমনি লুকা মদরিচও দারুণ ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন দলের হয়ে। যার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেলেন টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার, গোল্ডেন বল। ফিফা ও উয়েফার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। মেসি রোনালদোকে ছাপিয়ে পেয়েছেন ব্যালন ডি অর, হয়েছেন ইতিহাসের এক সোনালী মধ্যমাঠ শিল্পী।
ক্যারিয়ারের অন্তিম সময়ে হাজির হয়েছেন মদ্রিচ। হয়তো হুট করেই একদিন বুটজোড়া তুলে রাখবেন, পিচে আর মকবুল ফিদা হোসেন কিংবা মাইকেল এঞ্জেলো হয়ে আঁকবেন না আর কোন ফুটবলীয় রঙধনু আবিরে মাখা কোন সাফল্যগাথা। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালে অজস্র সাফল্যের রোমন্থন করবে তার খেলায় বুঁদ হয়ে থাকা ফুটবলমোদীরা। হয়তো একজন মিডফিল্ডার হবার কারণে ভুড়িভুড়ি গোল করা হয় নি তার, আসা হয় নি মেসি রোনালদোর মতো আলোচনার পাদপ্রদীপে। কিন্তু একটা কারণে অন্তত সবাই তাকে মনে রাখবে, তিনি হলেন সেই ফুটবলার যিনি ফুটবল মাঠে মেসি রোনালদো দ্বৈরথকে একপাশে রেখে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন ব্যালন ডি’অরের মঞ্চে, হাতে নিয়েছিলেন সেই সোনালী মুকুট, দর্শক সারিতে মেসি আর রোনালদো, যা এক যুগে কেউ করতে পারে নি। ভাবা যায়? এই স্বল্পভাষী রাজর্ষী কি অকল্পনীয় কাজটা করে ফেলেছেন!!
জাদারের এক যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবার থেকে উঠে এসে আজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন কোটি কোটি ফুটবল আমুদে দর্শকদের মনে, আর সেই সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন পৃথিবীর সকল মাদ্রিদিস্তার মনের গহীনে।
চোখে মায়াঞ্জন এঁকে দিতেই থাকো; হে, আমাদের এলএম-১০।