ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্মান ফুটবল ইতিহাস তো বটেই বিশ্ব ফুটবলের অনন্য এক নাম এই জার্মান মায়েস্ত্রো। যিনি জার্মান কাইজার (সম্রাট) নামে পরিচিতি পেয়েছেন শুধু ফুটবলীয় নৈপুণ্যের বদৌলতে। বিশ্বকাপে একাধিক পজিশনে খেলা এই লোকটা তার প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন একজন মিডফিল্ডার হিসেবে। সেখানেও তিনি বাজিমাৎ করেন। কোয়ার্টার আর সেমিতে ১ টি করে গোলসহ পুরো টুর্নামেন্টে ৪ গোল করে ব্রোঞ্জ বল জিতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার দল ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যায়। অবশ্য ফাইনালে হেরে গেলেও পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটা বগলদাবা করেন এই তরুণ বেকেনবাওয়ার।
আগের বিশ্বকাপে মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও পরের বিশ্বকাপে তিনি খেলেন একজন ডিফেন্ডার হিসেবে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানি বনাম ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড মুখোমুখি হলে পেয়ে যান আগের ফাইনালের ক্ষত মেরামতের সুযোগ। কিন্তু ৪৯ মিনিটেই ২ গোলে এগিয়ে গেলে ইংল্যান্ডের কাছে আবারও পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতে ফেরার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠে। না, খেলা এখানেই শেষ হয়ে যায় নি, ডিফেন্ডার বেকেনবাওয়ার ৬৮ মিনিটে গোল করে তার দলকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন এবং শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে জিতে সেমিফাইনালে পৌঁছে জার্মানি। কিন্তু এবারো হতাশা সঙ্গী হয় কাইজারের, সেমিফাইনালে ফুটবল ইতিহাসে ‘গেম অফ দ্য সেঞ্চুরি’ নামে খ্যাতি পাওয়া ম্যাচে ইটালীর কাছে ৪-৩ গোলে হেরে গিয়ে আবারো স্বপ্নভঙ্গ হয় তার। আগের বারের রানার্সআপ দল এবারে তৃতীয় হয়ে দেশে ফিরে যায়।
পরপর দুই বিশ্বকাপে শিরোপার কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসার ব্যার্থতা তাকে নিশ্চয়ই অনেক পুড়িয়েছে। হাল না ছাড়া মানসিকতার জার্মান ডিএনএ তাকে আরো খাটি করেছে। খেলোয়াড়ি জীবনে তৃতীয় বিশ্বকাপে এসে তাই কিস্তিমাত করলেন ‘কাইজার’। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলেন এবং মিউনিখের সেই ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে পরাজিত করে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেন ফ্রাঞ্জ ‘কাইজার’ বেকেনবাওয়ার। অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বীকৃতি হিসেবে সেই টুর্নামেন্টে সিলভার বল জিতে নেন তিনি। তিনবারের প্রচেষ্টাতেই সফল হয়ে ফুটবলের বিশ্বের সর্বোচ্চ আরাধ্য ট্রফিতে চুমু এঁকে দেন এই ফুটবল কিংবদন্তি।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনবার করে বিশ্বকাপের অলস্টার দলে নাম লেখাতে পারা দুজন খেলোয়াড়ের একজন হিসেবে ‘৬৬, ‘৭০ আর ‘৭৪ বিশ্বকাপের অল স্টার দলে সুযোগ পাওয়া বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এই ফুটবল মায়েস্ত্রো।
খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে সফল হওয়া বেকেনবাওয়ার কোচ হিসেবেও সফলতার মুখ দেখেন। যদিও কোচ হিসেবে তাঁর প্রথম বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যের কাছে তার দল হেরে যাওয়ায় সর্বোচ্চ সফলতার খুব কাছে গিয়েও ট্রফিটি ফিরিয়ে আনতে পারেন নি। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যারাডোনার বীরত্বের কাছে হেরে গিয়ে তার দল রানার্স আপ হবার আগুনে পুড়েছিল। কিন্তু ৪ বছর পর ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আবারও সেই ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে প্রতিশোধের সুবর্ণ সুযোগটি লুফে নেন তিনি ও তার শিষ্যরা। এবারে কোচ হিসেবে জিতে নিলেন সেই কাঙ্খিত সোনালি ট্রফিটি আর নিজেকে নিয়ে যান খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা বিরল উচ্চতায়।
মজার ব্যাপার হলেও সত্যি যে বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র দুজন মানুষ ‘খেলোয়াড় এবং কোচ’ দুই হিসেবেই বিশ্বকাপ জিতেছেন। আর এখানেও তিনি সেই দু’জন মানুষের একজন।
এ-তো গেলো শুধু বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের কথা, এবারে আসুন দেখে নিই ক্লাব ক্যারিয়ারেও কাইজারের প্রাপ্তি কি ছিলো। ক্লাব ক্যারিয়ারে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলে জার্মান বুন্দেসলীগা জিতেছেন ৪ বার। আর পরপর তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ (হালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) জিতে রিয়াল মাদ্রিদের যোগ্য সহযাত্রী করে তুলেন তার ক্লাবকে। যদিও তার পরে আর কেউ ওইভাবে বায়ার্ন মিউনিখকে টেনে নিতে পারে নি বলে শিরোপার বিচারে মাদ্রিদ পরবর্তীতে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এছাড়াও ব্যক্তিগত অর্জনের খাতায় খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি অর ২ বার ( ১৯৭২, ১৯৭৬) যোগ করে নেন।
এই হলো মাঠে ও ডাগআউটের সেই সফল ব্যক্তি, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। মাঠে ও মাঠের বাইরে তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলীর জন্য তাঁকে কাইজার বা সম্রাট নামেও ডাকা হতো। তাকে আধুনিক ফুটবলে সুইপার দক্ষতার উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ফুটবলের যে কোন সেরা একাদশ বানাতে চাইলে পেলে কিংবা ম্যারাডোনার বিকল্প হয়তো পাওয়া যেতে পারে, কোয়ালিটিতে তাদের সমতূল্য না হলে পরিসংখ্যানের জোরে তাদের বিকল্প পেয়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। কিন্তু একাদশে বেকেনবাওয়ারের বিকল্প খুজে পাওয়াটা দুষ্কর। যার প্রমাণ হিসেবে ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড সকারের নির্বাচিত সর্বকালের সেরা একাদশে পেলে ম্যারাডোনার চেয়েও বেকেনবাওয়ারের বেশি ভোট পাওয়ার কথা উল্লেখ করা যায়।
গত শতাব্দীর সেরা ফুটবল ব্যক্তিত্ব হিসেবে যৌথ ভাবে ফিফা থেকে পুরষ্কার পান ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে জন্ম নেয়া ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।