Soviet Union

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও স্নায়ুযুদ্ধের স্নায়ুচাপ

বাকি সব প্রজাতন্ত্রকে অন্ধকারে রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি প্রজাতন্ত্র- রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুসের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গোপনে একটি চুক্তিতে সই করেছিলেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। 

এই চুক্তির জের ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে এক কথায় টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

অবশ্য বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাবার পরে গর্বাচভের সময়টাও কঠিন হয়ে আসছিলো। পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র ততদিনে একপ্রকার ভেঙেই পরেছিলো। গর্বাচভ একাই সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের পতাকাটি উঁচিয়ে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। 

এছাড়া কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৯১ সালের অগাস্ট মাসে গর্বাচভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টাও চালায়। কারণ তারা গর্বাচভের গৃহীত উদারপন্থী কর্মসূচি ‘গ্লাসনস্ত ও পেরস্ত্রইকার’ ব্যাপারে খুশি ছিলেন না।

সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় গর্বাচভ বেঁচে গেলেও নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। কারণ ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই এর মধ্যে স্বাধীনতার দাবী জোরালো হয়ে উঠেছিলো।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক তখন পথ খুঁজছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। তিনি বলেন, সেসময় স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার প্রধান অগ্রাধিকার।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের শুরু

ইউক্রেন, বেলারুস এবং রাশিয়া- এই তিনটি প্রজাতন্ত্রের নেতারা বৈঠকে বসেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই বৈঠকের জের ধরেই আকস্মিকভাবে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের।

বৈঠকটি বেলারুশের প্রেসিডেন্ট স্তানিশ্লাভ শুশকেভিচের ডাকে পশ্চিম বেলারুসে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। যেখানে তার ডাকে সাড়া দেন রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন এবং ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক।

ইউক্রেন ততদিনে প্রকাশ্যে তার স্বাধীনতার আকাঙ্খার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে যদিও বেলারুশ তখনও সেরকম কোন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে নি। এমনকি বেলারুসের প্রেসিডেন্ট শুশকেভিচ এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে এই বৈঠকে যোগ দেওয়ার পেছনে বেলারুশের স্বাধীনতা বিষয়ক কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তার মনে ছিল না।

তিনি মূলত চেয়েছিলেন বেলারুশের কিছু জরুরী সেবা সরবরাহ নিশ্চিত করা। শুশকেভিচ তার দেশে শীতকালে তৈরি হওয়া তেল এবং গ্যাসের অধিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে।

তিনি তখন তাদের অর্থনৈতিক সংকটের কথা মাথায় রেখে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেবার চিন্তা করছিলেন। বিশেষ করে জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করার জন্য তাদের বেশকিছু ঋণের প্রয়োজন ছিলো, যদিও কেউ-ই তাদের ঋণ সহায়তা দিতে চাচ্ছিলো না তখন। তাই তিনি রাশিয়াকে অনুরোধ করতে যাচ্ছিলেন যেন শীতে জ্বালানির অভাবে তাদের জমে যেতে না হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের কুশীলব ও একজন মিখাইল গর্বাচভ

কিন্তু ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক একটু ভিন্নভাবেই ভেবেছিলেন। তার ভাবনাতে ইউক্রেনের স্বাধীনতা অর্জন, আর এতে করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনও যদি ঘটে তাতে তার কোন পরোয়া ছিলো না। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন-ই এই মিটিংয়ের মূল আলোচ্য বিষয় ছিলো।

এমনকি ক্রাভচুক তখন শুশকেভিচের তেল ও গ্যাসের ভাবনা নিয়েও ঠাট্টা করতে ছাড়েন নি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্যই সেখানে মিলিত হয়েছিলেন। কারণ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা তখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় একটা প্রজাতন্ত্রের জ্বালানি বিষয়ক নিশ্চয়তা আদায় নিয়ে ভাবনার মূল্য তিনি দেখেন না। আর তাই তিনি শুশকেভিচকে এই বিষয় নিয়ে খোচা দিতে ছাড়েন নি। 

বৈঠকের পূর্ব নির্ধারিত আলোচ্য-সূচি যাই হোক না কেন, রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিনসহ তারা তিনজন ভালো করেই জানতেন মিখাইল গর্বাচভকে না জানিয়ে এরকম একটা বৈঠকে বসা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ বলেন, “মিখাইল গর্বাচভের নির্দেশে সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির গোয়েন্দারা আমাদের গ্রেফতার করতে পারতো। কারণ কেজিবি তখনও গর্বাচভের অধীনেই ছিলো। তবে বেলারুসের গুপ্তচর সংস্থার প্রধান বরিস ইয়েলৎসিনের গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এবং তাদের গ্রেফতার করা হবে না বলে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।” অবশ্য মজার ব্যাপার হলেও সত্য যে পরবর্তীতে বেলারুশের গোয়েন্দা প্রধান তার অবসরের পরে এটা নিয়ে আফসোস করেছিলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন কেন তাদের তখন গ্রেফতার করেন নি তখন। 

মদের আসরেই এই সিদ্ধান্ত?

রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ ১৯৯১ সালের ৭ই ডিসেম্বর একটা বিলাসবহুল বাড়িতে বৈঠকে বসেছিলেন, যে বাড়িটি সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এ ধরনের বৈঠকে সাধারণত স্টিম বাথেরও ব্যবস্থা রাখা হয়, পাশাপাশি স্টিম বাথের পর, প্রচুর মদ্য পানের আয়োজন করা হয়। তবে সেবারের বৈঠকে মদ পানের পরিবর্তে মাসাজ বা শরীর মালিশ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো।

পর দিন ৮ই ডিসেম্বর সকাল ন’টায় এই তিন নেতা তাদের প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ জানালেন যে বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ব্যাপারে সমঝোতার প্রথম ধাপের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। কোন ধরনের তর্কাতর্কি ছাড়াই “ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআর-এর কোন অস্তিত্ব আর নেই” বিষয়ে বৈঠকে অংশগ্রহনকারী সবাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

মজার ব্যাপার হলো বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ প্রথম বলেছিলেন যে এতে সবার আগে সই করতে চান।

রাশিয়া পরমাণু চুক্তি

পরমাণু চুক্তির ফলে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভ কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। অপরদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে আরো কিছু ক্ষমতা চলে গেলো।

এবং এর মধ্য দিয়েইনকয়েক শতাব্দীর রুশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান ঘটলো। এটা ছিল বিরাট এক পদক্ষেপ। যদিও এর পরে অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জেগেছিল যে, এই তিন নেতা আসলেই সুস্থ মস্তিষ্কে এই চুক্তিতে সই করেছিলেন কি না।

দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়া চুক্তি

এর পরের কয়েক ঘন্টায় চুক্তির মোট ১৪টি অনুচ্ছেদ গৃহীত হয়। রাত তিনটে নাগাদ তৈরি হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘোষণার কাগজপত্র। এবার পুরো বিশ্বকে সেটা জানানোর পালা।

তবে তার আগে গর্বাচভকে জানানোটা-ই প্রথম কাজ বলে বিবেচ্য। তাদের মধ্যে কে গর্বাচভকে ফোন করবেন সেটা নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বরিস ইয়েলৎসিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে কল দিবেন আর বেলারুশের নেতা শুশকেভিচ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গর্বাচভকে ফোন করবেন বলে ঠিক হয়। 

একদিকে ইয়েলৎসিন তখন প্রেসিডেন্ট বুশকে ডায়াল করলেন। তিনি বুশকে যখন বোঝাচ্ছিল তারা কি করে ফেলেছে বা করতে যাচ্ছে আর তাঁর পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আঁন্দ্রে কোজিরেভ আরেকটি লাইনে প্রেসিডেন্ট বুশের কথা অনুবাদ করে যাচ্ছিলেন। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক তখন দু’জনের কথা শুনছিলেন।

অপরদিকে বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ গর্বাচভের অফিসে কল করে সরাসরি প্রেসিডেন্টকে পান নি, প্রেসিডেন্ট অফিসের কয়েকজনের কাছে তার পরিচয় ও ফোনকলের কারণ ব্যাখ্যার পর টেলিফোনে গর্বাচভের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেন। ইউক্রেনের নেতা ক্রাভচুক এখানেও তখন মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দুইপক্ষের মধ্যকার আলোচনা শুনতে লাগলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা

ইউক্রেনের নেতা ক্রাভচুক বলেন, “দু’জনের মধ্যে বিস্তর আলাপ হচ্ছিল। গর্বাচভ যে পুরো ঘটনা শুনে প্রচন্ড রেগে গিয়েছেন তা বুঝা যাচ্ছিলো। তিনি রাগত স্বরে বলছিলেন, এটা আপনারা কী করেছেন! আপনারা পুরো দুনিয়া উলট-পালট করে দিয়েছেন। সবাইকে আতংকের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন”।

শুশকেভিচ তখন গর্বাচভকে বললেন তারা কী ধরনের চুক্তিতে সই করতে যাচ্ছেন। গর্বাচভ তখন বললেন, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কী হবে? তখন তিনি বরিস ইয়েলৎসিন ও প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গটি আনলেন এবং প্রেসিডেন্ট বুশের যে এই বিষয়ে কোন আপত্তি নেই তাও জানালেন।

এর কয়েক ঘণ্টা পরেই বৈঠকে বসা তিন নেতা আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে সই করেন। সংবাদ সম্মেলনের পর তাদের বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে রেডিওতে তারা জানলেন কত বড় আর গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ তারা করে ফেললেন। অবশ্য মি. শুশকেভিচের আরেকটা আতঙ্ক ছিলো। আর সেটার কারণ হলো তাদের পার্লামেন্টের ৮২ শতাংশই সদস্যই কমিউনিস্ট ছিলো এবং তারা যদি চুক্তিটি অনুমোদন না করে, তাহলে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। 

তবে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ পর্যন্ত তিনটি আঞ্চলিক পার্লামেন্টেই এই সমঝোতা চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়। পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য প্রজাতন্ত্রগুলোও এতে যোগ দিতে শুরু করে।

আর ১৯৯১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ এর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

লিওনিদ ক্রাভচুক হন স্বাধীন ইউক্রেনের প্রথম প্রেসিডেন্ট। আর বেলারুসের প্রেসিডেন্ট হতে স্তানিস্লভ শুশকেভিচ যিনি ১৯৯৪ সালে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান।

বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিমা তথা আমেরিকার নেতৃত্ব তখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠে আর আমেরিকাও বিশ্বে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাপট দেখানোর পুরো একচেটিয়া অধিকার লাভ করে বলা যায়। শুধু রাশিয়া-ই যা একটু স্নায়ুযুদ্ধের স্নায়ুচাপ হয়ে আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের উপর কিছুটা হলেও ভর করে আছেন। হয়তো ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে নয়া ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের তৈরি হতে পারে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *