Ricardo Kaka

রিকার্ডো কাকা: দ্য সন অফ সানসিরো

তার কাছে ফুটবলের সবুজ গালিচাটা ছিলো একটা রঙ্গিন ক্যানভাস, আর পা দুটো ছিলো একেকটা পেইন্ট ব্রাশ; যা দিয়ে তিনি পেইন্টিং এর ম্যাজিক দেখাতেন এবং যিনি নিজেও ছিলেন একটা ম্যাজিক। বলছিলাম রিকার্ডো আইজ্যাকসন দোস সান্তোস লেইতে কাকার কথা। ব্রাজিল ফুটবল সমর্থক তথা আমার মতো হাজারো ফুটবল ভক্তের কাছে এক আবেগ, অনুভূতি এবং ভালোবাসার নাম। আমার মতো অনেকেই তার ফুটবলীয় যাদুতে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল, মিলান এবং রিয়াল ফুটবলের প্রেমে পড়ে। ছোট ভাই দিয়াগো তার রিকার্ডো নামটি উচ্চারণ করতে পারতেন না, তাই বড় ভাইকে ডাকতেন কাকা বলে। সেই থেকেই পাড়ায় কাকা নামে পরিচিতি তার। ছোট ভাইয়ের ডাকা নামেই যে ফুটবল বিশ্ব পরিচিত হবেন তিনি সেটাও বা কে জানতো?? 

কাকার জন্ম ১৯৮২ সালের ২২ ই এপ্রিল ব্রাজিলের গামা শহরে। ব্রাজিলের অন্যসব কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে, রোনালদিনহো, রোনালদোদের মতো তার শৈশবটা অভাব অনটনে কাটে নি। বাবা ছিলেন পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। তাই দারিদ্র্যতাকে সামনে থেকে দেখেন নি তিনি। তাই বলে নিজের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে মোটেও ভুল করেন নি তিনি। 

ফুটবলে কাকার সহজাত প্রতিভা ছিলো অন্যান্য ব্রাজিলিয়ানদের মতোই, আর থাকবেই না কেনো? জন্মই তো তার ফুটবলের তীর্থভূমিতে। মাত্র ৭ বছর বয়সেই কাকা ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সাও পাওলোর যুব দলে যোগ দেন এবং ১৫ বছর বয়সে ক্লাবটির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ঐ বছরই ক্লাবটির যুবদল কে ‘Copa de Juvenil’ জেতান। সাও পাওলো মূল দলে তার অভিষেক হয় ২০০১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি। প্রথম ম্যাচেই বদলি হিসেবে নেমে ১-০ তে পিছিয়ে থাকা দলকে জেতান পরপর দুই গোল করে। রাজপুত্র থেকে যুবরাজ হওয়ার গল্পের শুরুটা এখান থেকেই। প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের প্রথম সিজনেই সবার নজর কাড়েন নিজের অনবদ্য পারফর্মেন্সের দিয়ে। নিজের প্রথম মৌসুমেই করেন ২৭ ম্যাচে ১২ গোল। এবং পরের মৌসুমে (২০০২ সালে) ২২ ম্যাচে করেন ১০ গোল। ফলস্বরূপ হিসেবে জিতে নেন “Bola de oura” অর্থাৎ গোল্ডেন বল যা ব্রাজিলের ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ারের সমতুল্য। একই বছর সমগ্র ব্রাজিলে নিজের পজিশনের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন রিকি। একজন উঠতি তরুণের এমন অতিমানবীয় পার্ফম্যান্স চোখ এড়ায়নি তৎকালীন ব্রাজিলের কোচ বিগ ফিল খ্যাত স্যার লুইজ ফিলিপে স্কোলারির। রোনালদো, রোনালদিনহো, রিভালদোর মতো নক্ষত্রদের পাশে শুকতারা হয়েই জায়গা করে নিলেন ২০০২ সালের বিশ্বকাপ একাদশে। নিজের লাল টকটকে ঠোঁটে সোনালি বিশ্বকাপে  চুমু একেছেন মাত্র ২০ বছর বয়সেই। সাও পাওলো এবং জাতীয় দলে তার খেলার যাদুতে মুগ্ধ করেছেন রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলানের মতো ইউরোপের বড় বড় জয়ান্টগুলাকে। সেই সুবাদেই ২০০৩ সালে গ্রীষ্মকালীন দলবদলে মাত্র ২১ বছরেই যোগ দেন ইতালির সবচেয়ে সফলতম ক্লাব এসি মিলানে। 

এসি মিলানের কাকা

সান সিরো-তে রিকার্ডো কাকা

এসি মিলানে রিকি যোগ দিয়েছিলেন মাত্র ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোতে। সেই সময় মিলানের মিডফিল্ড ছিলো রুই কস্তা, রিভালদো, পিরলো, সিডর্ফের মতো বিশ্বসেরা সব তারকাদের দখলে। এতো এতো তারকাদের ভীড়ে দলে জায়গা পাওয়াটাই ছিলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু রিকি তো এমনই এক চরিত্র ছিলো যে কিনা তারকাদের ভীড়ে নক্ষত্র হতে পছন্দ করতেন। প্রথম দিনেই ট্রেনিং গ্রাউন্ডে নিজের দু-পায়ের যাদুতে মুগ্ধ করেন তৎকালীন মিলান বস ডন কার্লো আনচেলত্তিকে। রত্ন চিনতে ভুল করেন নি কার্লো, সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন আসলে দু পা দিয়ে কি কি করার ক্ষমতা রাখেন রিকি। মিলানে আসার মাত্র ১ মাস পরই অভিজ্ঞ রুই কস্তাকে বেঞ্চড করে এট্যাকিং মিডে আনচেলত্তি জায়গা করে দেন কাকাকে। কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে দেরি করলেন না কাকাও। অভিষেক ম্যাচেই শেভচেংকোকে দিয়ে করান ম্যাচ জয়ী গোল। দ্বিতীয় ম্যাচে নিজেই করে ফেলেন ৩০ গজ দূর থেকে চোখ ধাঁধানো একটি গোল। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। এর পরের অধ্যায়টা শুধুমাত্র ইতিহাস গড়ার জন্য বরাদ্দ ছিলো। অল্প দিনেই হয়ে গিয়েছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি ম্যাচেই দিয়ে গেছেন নিজের সৃষ্টিশীলতা এবং যোগ্যতার প্রমাণ। ইউরোপে নিজের প্রথম সিজনেই করেন ১৪ গোল এবং সেই সাথে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এসিস্ট। দীর্ঘ ৪ বছর পর দলকে জেতান লিগ টাইটেল। একই সাথে নিজের প্রথম সিজনেই নির্বাচিত হন ‘‘সিরি-আ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার” এবং “সিরি-আ ফরেইন প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’’। নমিনেশন পেয়েছিলেন “ব্যালন ডিওর’’ এবং “ফিফা প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’’ পুরষ্কারের জন্য। শেষ পর্যন্ত ব্যালন ডিওর-এ ১৫ তম এবং ফিফা প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ারে ৯ম স্থান লাভ করলেও জানান দিয়েছিলেন বিশ্ব ফুটবলে তার আগমনী বার্তার। 

শুধু লিগ সেরা হয়েই ক্ষ্যান্ত হননি রিকি। পরের সিজনে (২০০৪-০৫) লিগের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লীগেও নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গুলোতে ম্যাচের মোড় ঘুড়িয়ে দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। ফাইনালে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন দুইটি গোলও। কিন্তু বিধাতা সেদিন ইস্তাম্বুলের গল্প টা লিখেছিলেন অন্যভাবে। নয়তো লিভারপুলের সেই অসাধারণ কামব্যাক এবং পেনাল্টিতে মিলানের পরাজয়কে মিলানের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কি বা করার ছিলো। সেদিনের সেই ফাইনাল ম্যাচটি আজও “মিরাকল অফ ইস্তাম্বুল” নামে পরিচিত। চ্যাম্পিয়নস লীগ জিততে না পারলেও রিকি নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সেরা মিডফিল্ডার। সে বছর ব্রাজিলের হয়ে জিতেন কনফেডারেশন কাপ। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে করেন তার কালজয়ী গোলটি। মাঝমাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মেসিকে ড্রিবল করে নাকানি-চুবানি খাইয়ে করেন দুর্দান্ত একটি গোল। তার করা দুর্দান্ত সেই গোলটি টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়। 

পরের মৌসুমে ২০০৭ সালে মিলানে গাটুসো, সিডর্ফ, মেসিমো, রুই কস্তার সাথে মিলে একটি শক্তিশালী মিডফিল্ড গঠন করেন রিকি। নিজের ক্যারিয়ারের সেরা অধ্যায়টা রচিত হয় সেই বছরই। বহু বছর পর মিলানকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা জেতান তিনি। গ্রুপ পর্বে একটি হ্যাট্রিক, কোয়ার্টার ফাইনালে একমাত্র গোল, সেমিফাইনালে শক্তিশালী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুই লিগ মিলিয়ে ৩ গোল এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু এসিস্টের মাধ্যমে প্রায় একাই দলকে ফাইনালে টেনে নিয়ে যান রিকি। সেমি-ফাইনালের প্রথম লেগে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে করা দ্বিতীয় গোলটিতে যেভাবে প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলেছিলেন তা আজও ফুটবল প্রেমিদের কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। কাকার ক্যারিয়ারের সেরা তো বটেই, গোলটি শতাব্দীর সেরা গোল গুলোরও যে একটি এ ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়াও ফাইনালে ইনজাগি কে দিয়ে করিয়েছিলেন আরেকটি গোল। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের ব্যক্তিগত পুরষ্কারই জিতে নেন সে বছর তিনি। একই সাথে সময়ের দুই মহা তারকাকে পেছনে ফেলে ব্যালন ডি’অর জেতার পাশাপাশি  ফিফা বেস্ট প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার পুরস্কারও জিতে নিয়ে নিজেকে অমরত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। একইসাথে উয়েফা প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার পুরস্কার বগলদাবা করে জায়গা করে নেন ফিফপ্রো একাদশে। এরপর উয়েফা সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করে নিজেকে বিগ ম্যাচ প্লেয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। জিতেছিলেন ক্লাব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। একটি অনলাইন পোল দ্বারা ‘‘ভোডাফোন ফ্যানস প্লেয়ার অফ সিজন’’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও বছরের “IFFHS বেস্ট প্লেমেকার অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” পুরষ্কারও জিতে নেন রিকার্ডো কাকা।

আমার মনে আছে কাকা মিলান ছেড়ে যাওয়ার সময় আমরা দল হিসেবে এটাকে কতটা খারাপভাবে নিয়েছিলাম। দুই-তিন বছর তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। কারণ তখন তার সময়ে দলগুলি তাকে কীভাবে থামাতে পারে তার কোনও ধারণা ছিল না।

এরপর ২০০৯ সালে কাকা আবারো ব্রাজিলের হয়ে জিতেন কনফেডারেশন কাপ। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে জিতে নেন “গোল্ডেন বল এওয়ার্ড”। 

রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে কাকা

বার্নাব্যুতে কাকা

মিলান সমর্থকদের কাছে কাকা ছিল এক আবেগের নাম। মিলান সমর্থকরা তাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন “সুপার কাকা”। তারা কাকাকে নিজেদের ঘরের ছেলেই ভাবতো। তাই তো তাকে বলা হতো ‘‘দ্যা সন অফ সান সিরো’’। ২০০৭ সালে সেই ঘরের ছেলের দল বদলের গুঞ্জনকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মিলান বাসী তার বাসার সামনে জড়ো হওয়ার ঘটনা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু এক মৌসুম পরেই ২০০৯ সালে অনেকটা বাধ্য হয়েই অশ্রুসিক্ত চোখে প্রিয় ক্লাবকে বিদায় দিয়ে তৎকালীন রেকর্ড ৬৯ মিলিয়ন ( দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) ইউরোর বিনিময়ে ব্যার্নাব্যুতে পদার্পন করেন রিকি। ব্যার্নাব্যুতে আগমনটা রাজকীয়ভাবেই করেন। মিলান যুবরাজকে বরণ করতে সব আয়োজনই করে রাজকীয় মাদ্রিদ। আগমনটা যতটা রাজকীয়ভাবে হয়েছে কিন্তু সেটা ততোটা সুখকর হয় নি যুবরাজের জন্য। মাদ্রিদে যোগ দেয়ার পর ইঞ্জুরি যেনো ঘাড়ে চেপে বসে এই সাবেক বিশ্ব সেরার। তাই নতুন ক্লাবে পার্ফম্যান্সটা ঠিক কাকা সুলভ হয়নি। বার বার ইঞ্জুরির কালো থাবা, মেসুতের অতিমানবীয় পার্ফম এবং কোচ মরিনহোর অবহেলায় দ্রুতই নিজেকে হারিয়ে ফেলেন রিকি। আবেগের বশবর্তী হয়ে আমরা মরিনহোকে দায়ী করলেও মূলত কাকার ক্যারিয়ার ধ্বংসের মূল কারণ ছিলো ইঞ্জুরি। এদিকে তার জায়গায় মেসুতের দুদার্ন্ত পার্ফম। মাদ্রিদে তাই সময়টা ভালো যায়নি তার। বেশীরভাগ সময় সাইড বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয়। এরপরও কখনো কোচকে নিয়ে মিডিয়ায় মুখ খুলেন নি কাকা। কোচকে সবসময় নিজের সেরাটা দেওয়ার কথা বললেও আস্থা অর্জন করতে পারেন নি কোচের। রিয়ালে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১২০ ম্যাচ খেলে ২৯ গোল আর ৩২টি এসিস্ট করেন তিনি। জিতেছিলেন, ১ টি লা লীগা, ১ টি স্প্যানিশ কাপ ও ১ টি কোপা ডেল রে শিরোপা। ইঞ্জুরির কবলে পড়ে ২০১৩ সালে ৪ বছরের মাথায়ই শেষ হয়ে যায় কাকার রিয়াল অধ্যায়। ইঞ্জুরিটা না থাকলে হয়তো মাদ্রিদে তার ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো। 

এদিকে ২০১০ বিশ্বকাপে সময়ের সেরা তিন তারকাদের একজন হয়েই শুরু করেছিলেন আফ্রিকা যাত্রা। ভাঙ্গা পা নিয়ে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ এসিস্ট প্রোভাইডার হলেও শেষটা সোনায় মোড়ানো ছিলো না সেলসাওদের জন্য। ডাচদের কাছে কায়ার্টারে ২-১ গোলে হেরে হেক্সা জয়ের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেয় কোচ দুঙ্গার শিষ্যরা। বিশ্বকাপের পর ইঞ্জুরি আর ফর্মহীনতার কারণে দলে হয়ে পড়েন অনিয়মিত। মাঝে মাঝে স্কোয়াডে ফিরলেও ছিলেন না নিজের চেনা ছন্দে। পরবর্তীতে বাদ পড়েন ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপ এবং ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকেও। বিশ্বকাপের পর ফিরলেও স্থায়ী হতে পারেননি। ২০১৬ সালে জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলার আগে ৯২ ম্যাচে ২৯ গোল করেন কাকা। 

এরই মধ্যে ২০১৩ তে আবারো পুরনো ক্লাব মিলানে ফিরে যান কাকা। ঘরের ছেলেকে আবারো বরণ করে নিলো মিলান বাসী। কিন্তু নিজের পুরনো সেই ফিটনেস আর ফিরে পেলেন না। হেরে গেলেন ইঞ্জুরির কাছে। ক্যারিয়ারের মোটামুটি ইতি এখানেই টানা যায়। কেননা মুখ ধুবড়ে পড়া সেই মিলান কিংবা পরে জয়েন করা অরল্যান্ডো সিটি তে কাটানো সময় টা অনেকটা ঝরে পড়া ফুলের মতোই। তবে এর আগেই নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় খোদাই করে ফেলেছিলেন তিনি। তাই শেষ টা ভালো না হলেও জীবন্ত কিংবদন্তীর স্বীকৃতি পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি তাকে। বিশ্বকাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ এবং ব্যালন ডিওর জয়ী ফুটবল ইতিহাসের আট খেলোয়াড়ের একজন তিনি। ২০০৮ এবং ০৯ সালে টাইমসের মনোনীত বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জায়গা করে নিয়েছেন এসি মিলানের হল অফ ফ্রেমেও। তবুও আফসোস যেন থেকেই যায়। যদি না ইঞ্জুরিটা এতো ভোগাতো তাকে, যদি মরিনহোর প্রিয় পাত্র হতে পারতেন, তাহলে হয়তো ফুটবল বিশ্ব আরো কিছুদিন মুগ্ধ হতো তার ক্ষিপ্র দৌড়, মন ভোলানো সব পাস আর প্রতিপক্ষকে ছিটকে ফেলার দৃশ্য দেখে। দলের জন্য যে কত বড় সম্পদ ছিলেন তা বুঝাতে তারই এসি মিলান সতীর্থ আন্দ্রে পিরলোর এক বচনই যথেষ্ঠ ‘আমার মনে আছে কাকা মিলান ছেড়ে যাওয়ার সময় আমরা দল হিসেবে এটাকে কতটা খারাপভাবে নিয়েছিলাম। দুই-তিন বছর তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। কারণ তখন তার সময়ে দলগুলি তাকে কীভাবে থামাতে পারে তার কোনও ধারণা ছিল না ”।

কাকা এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন যাকে শুধু পরিসংখ্যান বা একটি ব্যালন ডিওর দিয়ে পরিমাপ করলে তার খেলার গভীরতা বুঝা যাবে না। আপনাকে দেখতে হবে ফুটবলীয় দৃষ্টিশক্তি দিয়ে। তিনি ছিলেন নিজের সময়ের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। তার প্রতিটা টাচ ছিলো আর্ট এর মতো, বল পায়ে ছিলেন পুরোদস্তর একজন শিল্পী। চিতার মত ক্ষিপ্রতা, দুর্দান্ত পাসিং এব্যিলিটি এবং একজন মিডফিল্ডার হয়েও গোল করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতাই কাকাকে করে তুলেছিল সময়ের সেরাদের একজন হিসেবে। তিনি দেখিয়ে গেছেন কিভাবে গোলের পর গোল না করেও নিজেকে সেরা হিসেবে প্রমাণ করা যায়। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নন, নিজের সুন্দর ব্যক্তিত্বের কারণে এখনও সব দলের সমর্থকদের কাছে এক ভালোবাসার নাম রিকার্ডো কাকা। তাই তো যখন ফুটবলকে বিদায় জানালেন, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি পৃথিবীর সব ফুটবল সমর্থকরা। ফুটবল থেকে বিদায় নিলেও আমার মতো হাজারো ভক্তদের মনে আজীবনের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন নিজের সৃষ্টিশীল খেলার মাধ্যমে, যেখান তিনি থেকে যাবেন আজীবন কোন বিদায় ছাড়াই। 

কাকা মানেই বল পায়ে গতি আর ড্রিবলিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে ছিটকে ফেলার দৃশ্য, চোখের প্রশমন। ফুটবল মাঠে তিনি কতটা সতেজ, প্রাণবন্ত আর নৃশংস ছিলেন সেটা তার প্রাইম দেখা মানুষগুলাই বলতে পারবে। তার ক্যারিয়ারটা হয়তো মেসি-ক্রিশ্চিয়ানোর মতো অতটা দীর্ঘায়িত হয় নি, পাঁচ-সাতটা ‘ব্যালন ডিওর’ বা ‘ফিফা বেস্ট প্লেয়ার’- এর এওয়ার্ড ও জিতেন নি। কিন্তু তার এই সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারের অর্জনগুলো হিংসায় ফেলে দিবে অনেক গ্রেট প্লেয়ারকেও। অতি স্বল্প সময়ে মাঠ এবং মাঠের বাইরে কাকা যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তা তার মতো করে কয়জনই বা করতে পেরেছেন। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *