বিশ্বকাপ ট্রফি

বিশ্বকাপ ট্রফি : একাল-সেকাল

বিশ্বকাপ ট্রফির পুরাকাল

বিশ্বকাপের আয়োজনের পর আয়োজক গোষ্ঠী ভাবলো চ্যাম্পিয়নদের প্রাইজমানির সাথে একটা ট্রফি দিলে মন্দ হয় না। যেই ভাবনা সেই কাজ, আয়োজক কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক একটি ট্রফি পুরস্কার হিসেবে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যার প্রাথমিক নাম হয় ‘ভিক্টোরি’ বা ‘বিজয়’ যা সাধারণ দর্শকের কাছে বিশ্বকাপ বা ‘কুপে ডে মুন্ডে’ (Coupe du Monde) নামে পরিচিত ছিলো। ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত, ফুটবল বিশ্বকাপের বিজয়ীকে এই ট্রফি পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় যা পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে ফিফার সাবেক সভাপতি জুলে রিমে’র নামানুসারে এই ট্রফির নাম রাখা হয় ‘জুলে রিমে ট্রফি’ যা ১৯৭০ সালে তৎকালীন তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে চিরদিনের জন্য দিয়ে দেয়া হয়েছিল। 

এবেল ল্যাফ্লু নামের একজন ফরাসি ভাস্কর জুলে রিমে ট্রফির ডিজাইন করেছিলেন, যেখানে বিজয়ের দেবীর প্রসারিত হাতে একটি অষ্টভুজাকার পাত্র রাখা হয়েছিল বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। মূল্যবান পাথরের ভিত্তির উপর সোনার তৈরি ট্রফিটি বসানো হয়েছিল।

বিশ্বকাপ ট্রফি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বকাপ ট্রফি রক্ষা করা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ইতালীতে সংরক্ষিত ছিলো। বিশেষত নাৎসিদের হাত থেকে এই ট্রফি রক্ষা করার জন্য ইতালির ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব ও ফিফার তৎকালীন সহ-সভাপতি ও এফআইজিসি-এর সভাপতি ইতালীর অধিবাসী অট্টোরিনো বারাসসি ট্রফিটি যে ব্যাংকে রক্ষিত ছিলো সেখান থেকে তুলে নিয়ে রোমে চলে যান এবং একটি জুতোর বাক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে সেটা নিজের বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখেন যাতে নাৎসিরা যেন জুলে রিমে ট্রফিটি বাজেয়াপ্ত করতে না পারে। ১৯৫০ এর বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত এটা তার কাছেই ছিলো। 

চুরি হয়েছিল ট্রফি

জুলে রিমে বিশ্বকাপ ট্রফিটি ১৯৬৬ সালের ফাইনালের কিক-অফের ঠিক আগে লন্ডনে প্রদর্শনীর সময় চুরি হয়ে যায়। দক্ষিণ লন্ডনের নরউডের একটি বাগানের হেজের নীচে লুকানো জায়গা থেকে চুরি করা ট্রফিটি পিকলস নামের এক কুকুর ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে খুজে বের করে ফেলে। পরবর্তীতে তার মালিক ডেভিড করবেট এই কাজের জন্য ৬০০০ পাউন্ড পুরস্কার পায়। অপরদিকে যে ব্যক্তিটি ট্রফি ফেরত দেওয়ার জন্য ১৫০০০ পাউন্ড মুক্তিপণ দাবি করেছিল তাকে গ্রেফতার করে দুই বছরের জন্য জেল দেওয়া হয়েছিল।

জুলে রিমে’র চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া

১৯৮৩ সালে ব্রাজিলের ট্রফি চুরি হয়। ১৯৭০ সালের ফাইনাল ম্যাচের পরে তৃতীয় বারের মতো জুলে রিমে ট্রফি বিজয়ী ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের চ্যাম্পিয়নস প্যারেড চলাকালীন ট্রফির শীর্ষপাতটি খুলে পড়ে যায় বা খোয়া যায়। ব্রাজিলিয়ান রিজার্ভ ডেভিও স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার সময় এক তরুণ দর্শকের কাছ থেকে মূল্যবান সোনার পাতটি উদ্ধার করা হয়।

পূর্বে বিজয়ী দলকে জুলে রিমে ট্রফিটি দেয়া হতো কিন্তু কিছুদিন পরে মূল ট্রফির একটি রেপ্লিকা দিয়ে মূল ট্রফিটি ফিফা আবার ফেরত নিয়ে আসতো। কিন্তু তিনবার কেউ চ্যাম্পিয়ন হলে তাদের একবারেই দিয়ে দেয়া হবে এমন নিয়ম থাকায় ১৯৭০ সালের বিজয়ী দল ব্রাজিল তিনবার ট্রফিটি জয়ের কারণে স্থায়ীভাবে এর মালিক হয়ে যায়। কিন্তু ব্রাজিলের দুর্ভাগ্য যে এই বিশেষ ট্রফিটি ১৯৮৩ সালে তাদের কাছ চুরি হয়ে গিয়েছিল এবং সেটি আর পাওয়া যায় নি এমনকি ট্রফিটির বর্তমান অবস্থান এখনো জানা যায়নি। ২০ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে রিওতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সদর দফতরের একটি ডিসপ্লে বক্স থেকে ট্রফিটি চুরি করা হয়েছিল এবং ধারণা করা হয় এটি কোথাও বিক্রি কিংবা সরিয়ে ফেলা ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় তা গলিয়ে ফেলা হয়েছিলো কিংবা অন্যভাবে নষ্ট করে দেয়া হয়েছিলো। যদিও এর সবই কেবল ধারণা মাত্র। পরবর্তীতে একজন জার্মান স্বর্ণকার জুলে রিমে ট্রফির একটু রেপ্লিকা তৈরি করে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে দান করেছিল।

জুলে রিমে থেকে বিশ্বকাপ ট্রফি

নতুন বিশ্বকাপ ট্রফি

১৯৭০ সালের পর, ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি নামে পরিচিত একটি নতুন ট্রফি ডিজাইন করা হয়েছিল। ১৮-ক্যারেট শক্ত সোনায় নির্মিত, ট্রফিটি ৩৬ সেন্টিমিটার (১৪ ইঞ্চি) লম্বা, এর গোড়ায় ম্যালাকাইটের দুটি রিং রয়েছে এবং মোট ওজন ৪,৯৭০  গ্রাম (১১ পাউন্ড)। নতুন ট্রফিটি ডিজাইন করেছেন সিলভিও গাজ্জানিগা। গাজ্জানিগার ডিজাইনটি ফিফায় উপস্থাপিত অন্যান্য মোট ৫৩টি ট্রফির মডেল থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। নতুন এই ট্রফিটি চ্যাম্পিয়ন দলকে স্থায়ীভাবে দেওয়া হয় না, তারা যতই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হোক না কেন। আসল ট্রফিটি ফিফার দখলে থাকে, আর বিজয়ী দলগুলোকে মূল ট্রফি নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেয়ার পর একটি সোনা মোড়ানো রেপ্লিকা দিয়ে মূল ট্রফিটি পুনরায় ফিফার দফতরে নিয়ে আসা হয়৷ তবে ২০৪২ সালে গিয়ে এই ট্রফিটিও কোন দেশকে দেয়া যাবে না, তখন নতুন একটা ট্রফির প্রয়োজন পড়বে। যার কারণ হলো, বর্তমান ট্রফির গোড়ায় নামের ফলকটি ১৯৭৪ থেকে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত ১৭ জন চ্যাম্পিয়নের নাম দিয়ে পূরণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। তাই ২০৪২ সালে একটি নতুন ট্রফি ব্যবহার করতে হবে এবং পুরনো ট্রফিটি ফিফা সদর দপ্তরে স্থায়ীভাবে রাখা হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *