ইনসমনিয়া

ইনসমনিয়া: নিদ্রা দেবীর অভিশাপ

সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ তার সারা দিনের ক্লান্ত শরীরকে পরবর্তী সময়ের জন্য চাঙ্গা ও কর্মক্ষম রাখতে ঘুমের কোন বিকল্প নেই। যারা বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা রাখলেই ঘুমের স্বর্গে চলে যান কিংবা নিদ্রা দেবী তার দুচোখের পাতায় তাঁর আশীষ দান করেন তারচেয়ে সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই।

কিন্তু বিভিন্ন কারনে যাদের রাতে ঘুম হয়না তাদের কষ্টের শেষ নেই।

একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ৭-৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। রাতে ঠিকঠাক ঘুম না হওয়া মানেই একটি ক্লান্ত সকাল আর অস্থির দিনের শুরু।

ইনসমনিয়া-র প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অফিস কিংবা বাড়ি যেখানেই হোক ঘুম ঠিকঠাক না হলে কাজেকর্মে তার প্রভাব পরবেই। তাছাড়া দীর্ঘদিনের নিদ্রাহীনতা আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুকিতে ফেলতে পারে।

যেমন, ওবেটিসি, হৃদরোগ, ত্বকের সমস্যা, হজমের সমস্যা, ডায়াবেটিস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি আপনার স্বাভাবিক জীবনের সকল সুখ শান্তি কেড়ে নিবে।

সুতরাং, বুঝতেই পারছেন আপনার শারীরিক ও মানসিক ফিটনেসে ঘুম কতটা জরুরি! তবে যাদের নিদ্রাহীনতা নামক সমস্যা টি রয়েছে তারা তো চাইলেই বাজার থেকে “ভালো ঘুম” কিনে নিয়ে আসতে পারেন না।

এক্ষেত্রে ভালো ঘুমের জন্য দরকার কিছু নিয়মনীতি, সাধ্য সাধনা এবং জীবনযাত্রার কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘুমের ওষুধ নিজেই প্রস্তুত করে নিতে হবে। 

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যাদের অনিদ্রা জনিত রোগ আছে, তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। আর সমস্যাটা যদি অসুস্থতার পর্যায়ে না পরে তাহলে জীবন যাত্রায় কিছু পরিবর্তন পারে আপনাকে প্রশান্তির ঘুম এনে দিতে। আসুন দেখি নিদ্রাহীনতা ও তার প্রতিকারে কি কি করণীয় আছে তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি: 

ঘুমের বড়ি খাওয়া চলবে না

কতক্ষন ঘুমাবেন:

বিভিন্ন বয়সে ঘুমের চাহিদা বিভিন্ন রকম।

প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য দৈনিক ৬-৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। ঘুমানোর সময় আমাদের শরীরে কিছু হরমোন নিঃসিরত হয় যেগুলো আসলে শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট। এই হরমোনগুলো শরীরকে টক্সিন মুক্ত করে, টানা ৬-৮ ঘন্টা ঘুমের ফলে আমাদের শরীর টক্সিন মুক্ত হয়ে আমাদের শরীর ও মনকে সতেজ ও কর্মক্ষম করে তোলে। তাই ভালো ঘুমের জন্য কোন আপোষ নয়।

মনে রাখবেন আপনার বাকি সব কাজের মতোই ঘুম ও অত্যন্ত জরুরী।। 

সময়🕝:

এবারে আসুন জেনে নিই একজন সুস্থ ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষের জন্য স্বাভাবিক ঘুমের সময়ের মাত্রা কেমন তা জেনে নেয়া যাক। আমাদের প্রত্যেকের শরীরে একটা নির্দিষ্ট বায়োলজিকাল ক্লক বা ঘড়ি আছে আর এই ঘড়ি কাজ করে দিন রাতের হিসাব অনুযায়ী। তাই একটি নির্দিষ্ট সময়েই ঘুমাতে চেষ্টা করাটাই উত্তম, প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের ঘুম শরীরের জৈবিক কার্যপ্রণালী ঠিক রাখে।

ঘুমের প্রস্তুতি :

সব কিছুর ই একটা প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরী। 

ঘুমের আগে তো সেটা আরো বেশি প্রয়োজন। ঘুমের আগে নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখুন। অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে না আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে ফ্রেশ করুন। ঢিলেঢালা কাপড় পরুন। হাল্কা পারফিউম ব্যবহার করুন কেননা সুঘ্রাণ একটা ভালো ঘুমের জন্য চমৎকার প্রস্তুতির কাজ করে।

ঘুমের পরিবেশ:

সত্যি বলতে কি নিজের ঘর ই নিজের স্বর্গ। তবে আরামদায়ক বিছানা অবশ্যই ভালো ঘুমে প্রভাব ফেলে অনেকটাই। ঘুমানোর ঘন্টা খানেক আগে অবশ্যই খেয়ে নিবেন। আর বলে রাখা ভালো রাতে অবশ্যই ভারী খাবার থেকে বিরত থাকবেন। বর্তমান যুগে অনিদ্রার প্রধান কারণ হলো স্ক্রিন টাইম। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে মোবাইল ল্যপটপ কম্পিউটার । বিশেষ করে ঘুমোনোর ঠিক আগে মোবাইল বা ল্যাপটপে ব্যস্ত থাকার প্রবণতা থেকে ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। কারণ স্ক্রিনের আলো মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণে প্রভাব ফেলে। এই হরমোন আমাদের ঘুমের সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে। স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো মস্তিষ্ককে বোঝায় এখনও দিনের আলো রয়েছে। ফলে ঘুম আসতে চায় না।

বাড়িয়ে দিক ঘুম তার হাত

ভাল ঘুমের ডায়েট:

ঘুমোনোর আগে ঈষদুষ্ণ দুধ খেতে পারেন। দুধে ট্রিপটোফ্যান নামক এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। এটি ভাল ঘুম আসতে সাহায্য করে। দুধে অসুবিধা থাকলে ক্যামোমাইল বা জ্যাসমিন চা খেতে পারেন। অবশ্যই চিনি ছাড়া। পান্তাভাতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ট্রিপটোফ্যান থাকে। তাই পান্তাভাত খেলেও ভাল ঘুম হয়। সারাদিনের ডায়েটে সবুজ শাকসবজি এবং ফল রাখুন। রাতের দিকে খুব বেশি তেলমশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। কারণ হজমের সমস্যা হলে ঘুম আসতেও দেরি হয়। অনিদ্রার সমস্যা থাকলে কফি খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। কফিতে থাকা ক্যাফেন ঘুম আসতে বাধা দেয়। তাই অনিদ্রার সমস্যা থাকলে কফি না খাওয়াই ভাল। বিশেষত বিকেলের পর একেবারেই কফি খাবেন না।

যোগব্যায়াম:

ঘুমের জন্য হালকা যোগব্যায়াম করুন।  ভ্রামরী প্রাণায়াম, শবাসন ভাল ঘুমের জন্য বেশ উপকারী। এছাড়া ঘুমের আগে মেডিটেশন করতে পারেন। এতে মন শান্ত হয় এবং ঘুম আসতে সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গেই বলে রাখি রাতের দিকে ভারী ব্যায়াম করবেন না। ওজন নিয়ে এক্সারসাইজ় করতে চাইলে বা জিমে যেতে হলে সকালবেলা যান। বিকেবেলা ক্লান্ত শরীরে ভারী ব্যায়াম করলে শরীর আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু উত্তেজনা বাড়ার ফলে ঘুম আসতে চায় না।

ঘুম হোক গভীর

কিছু সহজ টিপস:

আমাদের বেশিরভাগেরই অভ্যাস খাওয়ার পরই শুয়ে পড়া। এতে হজমে যেমন সমস্যা হয় তেমনই ঘুমও আসতে চায় না। খাওয়ার অনন্ত দু’ঘণ্টা পর ঘুমোতে গেলে সবচেয়ে ভাল। ঘুমের সমস্যা থাকলে রাতের দিকে একটু হালকা ডিনার করুন।

*সারাদিন বেশি করে পানি খান। রাতে ঘুমোনোর আগে পানি খাবেন না। বারাবার উঠে বাথরুম যেতে হলে ঘুমের ক্ষতি হয়। 

*বেডরুমে খুব বেশি উজ্জ্বল আলো না রাখাই ভাল।

*ঘুম না এলেই মুঠো মুঠো ওষুধ খাবেন না। বিশেষত ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। এতে ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

*দুপুরের দিকে বিশ্রাম নিন। কিন্তু খুব বেশি ঘুমোবেন না। এতে রাতের ঘুমের উপর প্রভাব পড়ে।

*ঘুমোতে যাওয়ার আগে স্নান করুন। ঠান্ডা লাগার সমস্যা থাকলে ঠান্ডা জলে মুখ, হাত, পা, ঘাড় ধুয়ে ভাল করে মুছে নিন। এতে শরীরে পেশি এবং নার্ভ শান্ত হয় এবং সহজে ঘুম আসে।

*সিগারেটে থাকা নিকোটিন ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে। দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে ঘুমানোর পরও ক্লান্তিভাব রয়েই যায়। তাই অনিদ্রার সমস্যা থাকলে ধূমপানের অভ্যেস ত্যাগ করুন।

*খুব গরম বা খুব ঠান্ডাতে ঘুমোতে সমস্যা হয়। তাই ঘরে ফ্যান, এসি বা হিটার যাই চলুক না কেন, চেষ্টা করুন ঘরের তাপমাত্রা যেন আরামদায়ক এবং সহনশীল হয়। 

অনিদ্রা খুবই অসহনীয় একটা সমস্যা, যার সমাধান হয়তো খুব সহজেই পাওয়া যায় না।  ভালো  ঘুমের জন্য অবশ্যই  মানসিক  স্বাস্থ্য  টা ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ  ব্যপার। তাই মানসিক  চাপ থেকে নিজেকে যতটা পারা যায় সরিয়ে রাখাই উত্তম।

তবে প্রাত্যহিক জীবনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারলে নিদ্রাহীনতা   সমস্যার অনেকটাই সমাধান করে নেয়া যেতে পারে। 

প্রাত্যহিক  রুটিন মেনে চলুন। অনিদ্রাকে জানিয়ে দিন টা টা বাই বাই।

সকলের সুস্থতা ও মঙ্গল কামনা করছি। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *