নারী যোদ্ধা: আলোকিত উদ্দীপন

যুগে যুগে পৃথিবীর বুকে অনেক যোদ্ধার আগমন ঘটেছে, অনেক বীরপুরুষদের বীরত্বের ইতিহাসে সমৃদ্ধ হয়েছে এই ভূপৃষ্ঠের সভ্যতা ও অসভ্যতার ইতিহাস। তবে আজ আমরা কথা বলবো এই পৃথিবীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবিলায় বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের পরিচয় দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ব্যবধান গড়ে দেয়া পাঁচ বীর নারী যোদ্ধাদের নিয়ে: 

তারামন বিবি: আমাদের সাহসী নারী যোদ্ধা

তালিকার প্রথমেই আমরা জায়গা দিতে চাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাম্মৎ তারামন বেগম ওরফে তারামন বিবিকে। তিনি ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন নির্ভীক সম্মুখ যোদ্ধা। স্বাধীনতার লড়াইয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে “বীর প্রতীক” উপাধি দেয়া হয়েছে। সরকারি গেজেট অনুসারে তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯৪।​

উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাঠি ইউনিয়নের কাছারিপাড়ার শংকর মাধবপুর গ্রামে তারামন বিবির জন্মগ্রহণ করেন। শংকর মাধবপুরে ১১ নম্বর সেক্টরে কিশোরী বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি গানবোট নিয়ে তারামন বিবির ক্যাম্পের দিকে আসার খবর পান, খবর পেয়ে তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সেই দলকে আক্রমণ করেন এবং সমুখ যুদ্ধের মাধ্যমে সেই শত্রুদলকে পরাজিত করেন। পরবর্তীতেও তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এসব যুদ্ধে বেশ কয়েকবার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, যা পরবর্তীতে রণাঙ্গনে তার সহযোদ্ধাদের মুখে শোনা যায়। বাংলার এই অসীম সাহসী কিশোরী ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর বয়সজনিত রোগে ভোগে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন তাঁর বীরত্বের আলোয় উদ্ভাসিত জন্মভূমি থেকে, শায়িত আছেন স্বাধীন দেশের বীর নারী যোদ্ধা হিসেবে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে।

তারামন বেগম ওরফে তারামন বিবি

ফুলন দেবী: বিপ্লবী নারী যোদ্ধা

উপমহাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে একটি নাম ফুলন দেবী। ভারতের লোকেরা তাকে চিরকাল মনে রাখবে ‘দ্রোহের প্রতীক’ হিসবে।  তাঁর মতো শারীরিক নিপীড়ন সহ্য করেও সমাজে নিজেকে ‘দ্রোহের প্রতীক’ রূপে প্রতিষ্ঠিত করে ফিরে আসার উদাহরণ খুব বেশি নেই। উত্তর প্রদেশের কানপুর থেকে শ’খানেক মাইল দুরের গ্রাম বেহমাইতে ১৯৭৯ সালে উচ্চবর্ণের ঠাকুর সম্প্রদায়ভুক্ত বেশ কিছু ‘অমানুষ’, ২৩ দিন যাবত তাকে শারীরিকভাবে পাশবিক নির্যাতন করেছিল। সবাই ভেবেছিলো তিনি মারা গিয়েছেন, কিন্তু না তিনি মারা যান নি, তিনি ফিরে এসেছিলেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে, ফিরে এসেছিলেন প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে৷ তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন, ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, বেহমাই গ্রামে উপস্থিত হয়ে তিনি নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছিলেন তার উপর পাশবিক নির্যাতন করা ২২ জন ঠাকুরকে। এই নির্মম প্রতিশোধ গ্রহনের পর তিনি বেশ কিছুদিন পালিয়ে ছিলেন, ছিলেন পত্রিকার শিরোনামে, ফলোআপ রিপোর্টে।

পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আশ্বাসে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর ছবি এবং দেবী দুর্গার প্রতিমার সামনে। আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ১১ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে সাজা শেষ করেও ফিরে এসেছিলেন সমাজে নারীর অধিকার ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ও নিজেকে ধর্ম, বর্ণ ও জাতপাতের ঊর্ধ্বে তুলে নারীসমাজে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে। তিনি দু’বার লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে দুঃখজনকভাবে ২০০১ সালের ২৫ জুলাই শের সিং নামের এক কুলাঙ্গার তাঁকে হত্যা করে, পুলিশী তদন্তে জানা যায় বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতেই এই বীর নারী যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।

ফুলন দেবী

লায়লা খালেদ: সংগ্রামী নারী যোদ্ধা

ফিলিস্তিনের হাইফা শহরে জন্ম নেয়া লায়লা খালেদ নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হন সপরিবারে। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের দখলদারত্বের কারণে নিজের মাতৃভূমি থাকার পরেও অন্য দেশ লেবাননে শরণার্থী হিসেবে বেড়ে ওঠেন। লেবাননে থেকেও নিজ দেশের প্রতি হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের স্বপ্ন লালন করে আসছিলেন প্রতিনিয়ত। তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন ফিলিস্তিনের, স্বপ্ন দেখতেন নিজ দেশে তিনি বেড়ে উঠার সুযোগ না পেলেও তার পরবর্তী প্রজন্ম যেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিনে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়।

এই উদ্দেশ্যেই তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত ‘পপুলার ফ্রন্ট দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’ এ যোগ দেন এবং গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। পরবর্তীতে সাহসী এই নারী  একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তাঁর দলের কয়েকজন সদস্যের সাথে বিমান ছিনতাইয়ে অংশ নেন। পাইলটকে তিনি হাইফা হয়ে দামেস্ক যেতে বাধ্য করেন। বিমান আরোহীদের মধ্যে দু’জন ইসরাইলীকে জিম্মি রেখে বিমানের সকল যাত্রীকে দামেস্কে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে ইসরায়েলি জিম্মিদের পুঁজি করে  ইসরায়েলের সঙ্গে বন্দিবিনিময় করা হয়। ছিনতাইকৃত বিমানটির সামনের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। বিমান ছিনতাইয়ের সময় এডি এডামস নামক এক ব্যক্তি লায়লার একটি ছবি তোলতে সক্ষন হন, যে ছবিতে লায়লা একটি একে-৪৭ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে এ ছবিটা বিপ্লব ও দ্রোহের প্রতীক হিসেবে খ্যাতি লাভ করে এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। গেরিলা লায়লা খালেদ বেঁচে আছেন, বর্তমানে লন্ডনে বাস করেন।

লায়লা খালেদ

রেহানা: অকুতোভয় নারী যোদ্ধা

২০১০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ও সিরিয়ার দীর্ঘ এলাকা চলে যায় বর্বর জল্লাদ আইসিসের কব্জায়। এদের বর্বরতা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। সে সময়ে কুর্দি গেরিলারা (YPJ) সিরিয়ায় নিজেদের অঞ্চলে আইসিসকে রুখে দিয়েছিল। এবং সেই প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন কুর্দি নারী গেরিলারা। তাঁদেরই একজন রেহানা, তিনি কোবান অঞ্চলের মানুষ। তিনি হত্যা করেছিলেন শতাধিক আইসিস জল্লাদকে। এই ঘটনা টুইটার এবং অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছিল। ২০১৪ সালের অক্টোবরে আইসিস দাবী করে রেহানাকে তারা হত্যা করেছে, প্রমাণ হিসেবে একটি শিরোচ্ছেদ করা ছিন্ন মাথা প্রদর্শন করে। তবে কুর্দি গেরিলারা এই দাবী প্রত্যাখ্যান করে। হয়তো রেহানা আজো বেঁচে আছেন, হয়তো নেই। তাঁর বীরত্ব আরব নারীদের মাঝে ছড়িয়ে পরুক এটি চাওয়া।

রেহানা কুর্দি

আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (IRA)-র অজ্ঞাত এক সাহসী নারী যোদ্ধা:

আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (IRA) ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল লড়াই চালিয়ে আসা একটি সংগঠনের নাম। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের কার্যক্রম যথেষ্ট ভীতির সঞ্চার করেছিল ব্রিটিশ শাসকদের মনে। তাদের সহিংস স্বাধিকার আন্দোলন ছিলো চরমপন্থী ধরনের। তাদেরই একজন নারী যোদ্ধাকে ১৯৭০ সালে বেলফাস্টে আমেরিকার তৈরি AR18 অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের দিকে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। যে ছবিটি তুলেছিলেন আইরিশ আলোকচিত্রী কোলম্যান ডয়লে। ছবিটি প্রকাশ পাবার পর থেকেই যেন এটি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিদের প্রতি আর আইরিশদের স্বাধীনতার প্রতি তাদের জনগণের একাত্মতা বেড়ে গিয়েছিলো। ছবিটিতে নারী যোদ্ধাটির মুখের অবয়ব বুঝা যায় নি, আর আলোকচিত্রীও তার সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেন নি বা জানাতে চান নি। তাই এই গেরিলা যোদ্ধার পরিনতি সম্পর্কে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়না এমনকি তাঁর নামও অজানা।

আলো আসবেই

এখানে মাত্র পাঁচজন সাহসী নারী বীরযোদ্ধাদের কথা আলোচনা করলেও পৃথিবী জুড়ে আরো অসংখ্য এমন সাহসী, বুদ্ধিমতী ও চৌকস নারী যোদ্ধা তাদের চিহ্ন রেখে গিয়েছেন কালে কালে। যাদের অবদান, যাদের আত্মত্যাগ আমাদের সভ্যতাকে ঋণী করেছে তাদের সময়ে। আমরা তাদের সম্মান জানাই, তাদের ত্যাগ ও সাহসিকতার শিক্ষা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার এক সুমহান ভারসাম্য তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে এই ভূ-খণ্ডে এক সমতাসূচক অবস্থান তৈরি করতে অবদান রাখতে তাদের ত্যাগই হোক আমাদের জীবনের অন্যতম পাথেয়৷ 

স্বাধীনতার এই মাসে সকল মুক্তি কামী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই অসীম ভালবাসা ও সম্মান। আমরা আপনাদের কাছে ঋণী ও দায়বদ্ধ। একদিন আপনাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে নিবো সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আমরা কৃতজ্ঞ।

জয় বাংলা, জয় হোক বাংলাদেশের সকল নারী’র, সকল সাহসী নারদের অনুপ্রেরণা হোক কিংবদন্তি নারী বীর যোদ্ধাগণ, জয় হোক মানুষের, জয় হোক মানবতার।

সারমর্ম পরিবারের সকল নারী সদস্যের প্রতি আনত কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা রইলো

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *