প্রিয় পাঠক, এর আগে দুটি পর্ব ইন্ট্রোভার্ট এবং এক্সট্রোভার্ট সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আপনাদের বলেছিলাম তৃতীয় আরেক প্রকৃতির মানুষের কথা!
আজ আপনাদের সঙ্গে সেই তৃতীয় পর্বের মানুষদের নিয়েই আলোচনা করব। আপনি কি জানেন এমবিভার্ট কারা? তাদের আচরণ কেমন? পৃথিবীতে এই পর্বের মানুষের সংখ্যা কেমন? আপনার এই সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন এখনি। চলুন জানা যাক।
এমবিভার্শন বা এমবিভার্ট এর পরিচিতি :
‘এমবিভার্ট’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ। ১৯২৭ সালে আমেরিকান মনস্তাত্ত্বিক ‘কিম্বল ইয়ং’ প্রথম এই শব্দটি আবিষ্কার করেন। ‘এমবিভার্ট’ শব্দটি মূলত দুটি শব্দের সংমিশ্রণে গঠিত। এর প্রথম অংশ ‘এমবি’ যার ইংরেজি অর্থ ‘রাউন্ড এবাউট’ অর্থাৎ চারপাশে, আর পরের অংশ হল ‘ভারটারা’ যার ইংরেজি অর্থ হল ‘টু টার্ন’ অর্থাৎ ঘোরানো। আর এই শব্দের যে সমস্ত গুণাবলি রয়েছে এগুলোকে বলে ‘এমবিভার্সন’। এর বিপরীত শব্দ হল ইন্ট্রোভার্সন এবং এক্সট্রোভার্সন।
এমবিভার্ট এর সংজ্ঞায়ন :
এবার আসি এমবিভার্সন এর সংজ্ঞায়। সংজ্ঞা প্রদানে ইংলিশ অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা হয়েছে, ‘A person who has a balance of extrovert and introvert features in their personality.’
অর্থাৎ অন্যভাবে বলতে গেলে, ‘এমবিভার্ট এমন এক প্রকার মানুষদের সংজ্ঞায়িত করে, যারা একই সাথে একজন ইন্ট্রোভার্ট এবং এক্সট্রোভার্ট উভয়ের আচরণকে ধারণ করে থাকেন।’
এমবিভার্টদের নিয়ে পৃথিবীর মানুষদের মাতামাতি শুরু মাত্র বিংশ শতাব্দীতে এসে। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন! আপনি নিজে একজন এমবিভার্ট কি না! বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিস্তর গবেষণা ইতিমধ্যে আমরা পেয়ে থাকি। একজন এমবিভার্ট ধর্মী মানুষ কি ধরনের আচরণ করতে পারে, কিংবা একজন এমবিভার্ট কিভাবে জীবন ধারণ করে এবং সেখানে বিশেষ কোনো দিক পরিলক্ষিত হয় কিনা এ সকল বিষয়ে মতামত দিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নামীদামী গবেষকেরা।
এমবিভার্টদের আচরণ :
ডব্লিউএসজে (www.wsj.com) এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এমবিভার্ট স্বভাবের মানুষেরা যখন ইন্ট্রোভার্টদের মত আচরণ করে (চুপচাপ একাকী) তখন তারা নিজেরাই আশেপাশের সবার উপর বিরক্ত হয়ে যায়, উল্টোদিকে যখন তারা এক্সট্রোভার্টদের মত আচরণ করে তখন তারা নিজেরাই নিজেদের উপর বিরক্ত হয়ে যান। মূলত এই উভধর্মী এই বৈশিষ্ট্যের উপস্তিতির কারণেই এই আচরণের মানুষগুলো দুটো চরিত্রকেই ধারণ করে তৃতীয় আরেকটি চরিত্র প্রকাশ করে থাকে। যাকে আমরা এমবিভার্শন বলে আখ্যায়িত করে থাকি “
ব্রিটিশ মনস্তাত্বিক ‘ব্রায়ান লিটল’ এমবিভার্টদের বিশেষায়িত করতে গিয়ে বলেন- এমবিভার্ট ধর্মী মানুষেরা তাদের জীবন চলার পথে নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। একজন এমবিভার্ট কখনোই নিজের উপর অন্য কারো হস্তক্ষেপ মেনে নিতে চায় না।
অন্য অনেক মনস্তাত্বিক মনে করেন- এই ধরনের মানুষেরা একদিকে যেমন মনের দিক থেকে শক্ত হয়ে থাকেন অন্যদিকে যেকোনো কঠিন সময়ে ভেবে চিন্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
এমবিভার্টদের সংখ্যা প্রকাশে সুইস মনোবিজ্ঞানী ‘রবার্ট আর. ম্যাকরে’ বলেন, ‘পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষ এমবিভার্ট।’
আমেরিকান বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক ‘এডাম এম. গ্রান্ট’ এমবিভার্টদের নিয়ে আলোচনায় বলেন- ‘পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ এমবিভার্ট।’ (যদিও তার এই মতামত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)
এমবিভার্টদের বৈশিষ্ট্য :
ইন্ট্রোভার্ট এবং এক্সট্রোভার্টদের ন্যায় এমবিভার্টদের ও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
১. নতুন সামাজিক সম্পর্কে জড়াতে অভ্যস্ত, বন্ধুত্ব গড়তে পটু এবং সম্পর্ক রক্ষায় সিদ্ধহস্ত বলা যায় এদের।
২. এরা অল্পতেই আশেপাশের মানুষদের বিশ্বাস করে ফেলেন, আবার একই সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ হলে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন যা তাদের মানসিক শক্তির ইঙ্গিত বহন করে।
৩. প্রচুর আড্ডা ও ভ্রমণপ্রিয় হয়ে থাকে এই ধরনের মানুষেরা, পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খুব সুন্দর করে সময় কাটাতে পারেন।
৪. আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ রক্ষায় পটু হয় এরা।
৫. সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবার কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেন যাতে আশেপাশের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন, হলেও তা অল্প পরিমাণে বা অল্প প্রভাব বিস্তার করে।
৬. কাজের ক্ষেত্রে দলগত কাজেও যেমন স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন তেমনি একা একাও নিজের কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন।
৭. নিজের সাথে সম্পর্কিত সবার সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন।
৮. সংগঠক হিসেবেক এরা নিজেদের দক্ষতার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
এমন আরও অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য নিয়েই মূলত একজন এমবিভার্ট বেঁচে থাকেন।
এমবিভার্টদের ভালো দিক সমূহ :
একজন ইন্ট্রোভার্ট কিংবা এক্সট্রোভার্টদের যেমন কিছু পজিটিভ দিক থাকে তেমনি একজন এমবিভার্ট মানুষের ও অনেকগুলো পজিটিভ দিক রয়েছে। যেমন-
১. ছোট বেলা থেকেই স্বাধীনচেতা এই জনগোষ্ঠী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করতে পছন্দ করেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
২. এরা খুব সহজেই দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নিতে পারেন।
৩. যে-কোন জায়গায় নিজের উন্নত ব্যক্তিত্ব ধারণ করেন।
৪. পরিবারের সবার স্বার্থ চিন্তা করে চলেন, সবার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করেন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বার্থে আঘাত না করেও একজন এমবিভার্ট সন্তান নিজের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ করে নিতে পারেন।
৫. একজন এমবিভার্ট কাউকে একবার ভালোবাসি বললে সেটা উজাড় করেই ভালোবাসেন এবং ভালবাসার প্রকাশে কোন কার্পন্য করেন না।
৬. একজন এমবিভার্ট সাধারণত নিজের মন খারাপ থাকলে কিংবা খুব কষ্টে থাকলেও সেটা খুব একটা প্রকাশ করেন না কিংবা আপনাকে বুঝতে দিবে না, বরং আশেপাশের লোকেদের মন খারাপের খবর নিতেই ব্যস্ত থাকবে।
৭. একজন এমবিভার্ট সর্বোচ্চ সহযোগিতাপরায়ন হোন, কেউ সাহায্য চাইলে মুখের উপর না করেন না, হাসিমুখেই তা করে দিতে সচেষ্ট হোন।
৮. তারা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দেন, সাধারণত এরা গান-নাচ, আবৃত্তি, লেখালেখিতে পারদর্শী হয়ে থাকে।
৯. কাজের ব্যাপারে খুবই সচেতন ও কর্মঠ হয়ে থাকেন।
১০. অন্য কোন বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝানোর দক্ষতা তাদের স্বভাবজাত।
১১. একজন শ্রোতা হিসেবে তাদের জুড়ি মেলা ভার।
এমন আরও অনেক ধরনের ইতিবাচক দিক তাদের চরিত্রে দেখা যায়।
এমবিভার্টদের খারাপ দিক সমূহ :
এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোর কিছু নেগেটিভ দিকও রয়েছে। যেমন :
১. বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া স্বত্তেও পুনরায় একটু মন ভোলানো মিষ্টি কথায় অন্যজনকে বিশ্বাস করে।
২. কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ করেন, অনেকক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেও সময়ক্ষেপণ করার কারণে তার বাস্তবায়ন আটকে যেতে পারে।
৩. এরা সকলের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারলেও নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষী নেই মনে করে একধরনের চাপা হতাশা বয়ে বেড়ানো তাদের চরিত্রে দেখা যায়
৪. জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই এরা আশেপাশের অন্যদের থেকে একটু এগিয়ে থাকায় অনেকের পরশ্রীকাতরতার শিকার হন।
৫. কাউকে তেল মারতে পারেন না বলে বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে বসকে খুশি করার জন্য কৃত্রিম আবেগ দেখাতে পারেন না বলে অনেক সময় মানুষগুলো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়ে থাকে।
এ সকল দিক নিয়েই একজন মানুষ এমবিভার্ট হয়ে থাকে। বলুন তো আপনি কোন প্রকৃতির মানুষ! ইন্ট্রোভার্ট, এক্সট্রোভার্ট, নাকি এমবিভার্ট ধর্মী? জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।