যুদ্ধ চাই না

ন্যাটো-রাশিয়ার দাবার বোর্ড ইউক্রেন

ইউক্রেন নিয়ে ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনার সর্বশেষ ধাক্কাটি মানবতার উপর অত্যন্ত  দুঃখজনক একটা ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভোরবেলার ঘুম জড়ানো টেলিভিশন ভাষণে ইউক্রেনের উপর যেঁ সামরিক আগ্রাসনের ঘোষণা করেন এবং তারপরই মস্কো ইউক্রেনের উপর যে স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে আক্রমণ চালায় তা সমগ্র পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। শুক্রবার রাতে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ান আক্রমণের প্রথম দিনে 137 ইউক্রেনীয় নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যখন ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সামরিক বাহিনী চেরনোবিলের আগের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কিয়েভের অভ্যন্তরে হোস্টোমেল বিমানবন্দর দখল করে নিয়েছে। এদিকে, শুক্রবার রাশিয়ান ট্যাঙ্ক রাজধানীতে প্রবেশের সাথে সাথে কিয়েভের রাস্তা গুলির শব্দে কেঁপে উঠছিলো। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল  কোর্টের (আইসিসি) প্রসিকিউটর এই আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজনের সুযোগও নেয়া যায় কি না তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।  

মুখোমুখি রাশিয়া-ইউক্রেন

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল  কোর্টের (আইসিসি) প্রসিকিউটরদের একজন বলেন, “আমরা প্রথমে ইউক্রেনের জনগণের সাথে আমাদের সংহতি প্রকাশ করতে চাই এবং বরাবরের মতো, রাশিয়ার মাধ্যমে শুরু হওয়া যুদ্ধের নিন্দা জানাই”। তিনি আরো উল্লেখ করেন, “এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে খারাপ হিসাবে পরিচিত হচ্ছে-পশ্চিম থেকে অনুভূত বিপদের মুখে রাশিয়াকে ব্যবহার করে একটি আকস্মিক এবং অর্থহীন আক্রমণ। এটি অবিচার এবং অযৌক্তিকতার উচ্চতায় যে রাশিয়া এবং ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে ইউক্রেনের জীবন নষ্ট করা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।“

যুদ্ধ নয় শান্তি চাই



অবশ্য ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য আমরা পৃথিবীব্যাপি রাশিয়ার নিন্দা করেই দায় এড়াতে পারি না, আমরা কখনোই এটা দাবি করতে পারি না যে এই আগ্রাসনের পেছনে পশ্চিমাদের কোনো দায় নেই। প্রথমত ১৯৯৯ সালে এবং দ্বিতীয়ত ২০০৮ সালে ন্যাটোর ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে তার পরিধি বিস্তারের যে পরোক্ষ নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছিলো তার বিরোধীতা রাশিয়া করে আসছিলো জোরেশোরেই। তবে ন্যাটো সেদিকে কার্যত কোন কর্ণপাত করে নি বললেই চলে। রাশিয়া বরাবরই ন্যাটোর ব্যাপ্তি নিয়ে অনেকটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলো বা আছে তা তার বক্তব্যে বিভিন্ন সময়েই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে আসছিলো, বিশেষ করে পুর্ব ইউরোপে ন্যাটোর পরিধি বৃদ্ধি তার নিরাপত্তা তথা মুরব্বীগিরি বাধাগ্রস্থ হবে এবং আমেরিকা তথা ন্যাটোর দাদাগিরি এই অঞ্চলে বেড়ে যাবে যা রাশিয়া মানতে পারে নি কোনভাবেই।

ন্যাটো-রাশিয়ার জুয়ার দানে ইউক্রেন

পশ্চিমারা স্পষ্টতই রাশিয়াকে বিশেষ করে পুতিনের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ধরে রেখে তার বলয় বজায় রাখার নীতিকে পাশ কাটাতে গিয়ে ইতোপূর্বে জর্জিয়া ও ক্রিমিয়া দখল ঠেকাতে না পারায় পুতিনের ইউক্রেন আক্রমনের জেদ বাস্তবায়নে রসদ জুগিয়েছে বলা যায়। রাশিয়ার উপর ইউরোপ ও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপকে পুতিনের এশিয়া ও আফ্রিকাকেন্দ্রিক বলয় ঘঠনেও উদ্যগী করে বলা যায়। এক্ষেত্রে রাশিয়া তার পাশে মিত্র হিসেবে পেয়েছে এশিয়ার দুই বড় শক্তি চীন ও ভারতকে অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার পরাশক্তি ব্রাজিলের সাথে আফ্রিকার বড় অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যার বড় একটা প্রমাণ বলা যায়। ঠিক এই যায়গাতেই আমেরিকা ও তার মিত্রেরা মার খেয়ে যেতে পারে ব্যাপকভাবে। কারন রাশিয়ার পাশে আছে বিশের সবচেয়ে বড় ও সস্তা বাজারের মালিকেরা তেমনি রয়েছে রাশয়ার উপর সমগ্র পূর্ব ইউরোপের গ্যাস নির্ভরতা। আর এখানেই পুতিনের দাবার বোর্ডে রয়ে যায় কিছু রাজনৈতিক ঘোড়ার চাল, যার আড়াই ঘরে সে বাজিমাত করে ফেলতে পারে বলে মনে করা হয়।

এখন যেহেতু পরিস্থিতি একটি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, এবং এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে পৃথিবীর তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসমুহ সেহেতু এর ফলাফল অনিবার্যভাবে ভূ-পৃষ্ঠের সকল দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশেও পড়বে( ইতমধ্যে ভোজ্যতেলের দরবৃদ্ধির সাপলুডু খেলায় মূল্যবৃদ্ধি মইয়ের নাগাল যেন ছাড়ছেই না)। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেলেই সাধারণ জনগণের আয় আর ব্যয় মিলাতে গিয়ে লেজেগোবরে হয়ে যাবে তা নিপাতনে সিদ্ধ না হয়ে যে একদম কষা  ভূনা হয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে কি না তা আমাদের রাজনৈতিকদের জানা আছে বলে মনে হয় না। যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফলে কে জিতবে তার হিসাব করা সহজ হলেও হতে পারে তবে এর নেতিবাচক প্রভাব যে কতটা মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে তা হিসাব করে নির্ণয় করা যাবে কি না সেটা যুদ্ধবাজ নারদেরা বুঝবে কবে খোদায় মালুম। ইতোমধ্যেই যুদ্ধের বন্দুক, কামান আর গোলা দিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে উস্কে দিয়ে এবং বৈশ্বিক ডেলিভারি চেইনকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছে তাতে এর প্রভাব নির্ণয় করা কার্যতঃ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

শান্তি চাই, যুদ্ধ নয়

যাইহোক,  রাশিয়ান আক্রমণ থেকে ইউক্রেনিয়ানদের রক্ষা করা-ই বিশ্ব মাতব্বরদের কর্ম তালিকায় প্রাথমিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই পৃথিবীব্যাপি যত সমস্যা আছে তার সমাধান পারস্পরিক আলোচনা ও কেবলমাত্র পারস্পরিক রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব। আমরা এটাই আশা করি যে যুদ্ধদেবতা অ্যারিস পরাজিত হবেন এবং  আলোচনার জয় হবে।

করোনা পরিস্থিতি বিরাজমান থাকা অবস্থাতে যেখানে আমরা প্রাণঘাতী মহামারীর বিরুদ্ধে এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছি সেখানে আমাদের এখন ইউরোপে যুদ্ধের দরকার নেই, এমনকি এই পৃথিবী নামক গ্রহটি এই মুহুর্তে আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এফোর্ড করতে পারে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *