তেপান্তরের প্রেম

মধ্যরাত! বেলকনিতে বসে থেকে হাতের মোবাইল ফোনটি বরাবরের মতোই একটু পর পর নিভে যাচ্ছে আর সাথে সাথে আনলক বাটনটিতে চাপ দিয়ে  জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছি ফোনের ঘুমোতে চাওয়া স্ক্রিনটিকে। যান্ত্রিক আলোর এই জ্বলা-নেভাটা মন্দ লাগছে না। আবার ভেতরে একটু অস্থিরতা থাকায় খুব একটা ভালোও লাগছে না। আসলে কিছুই করার নেই বলেই নিজের সাথে ফোনটাকেই জাগিয়ে রাখছি।

নিচের খোলা জায়গায় ৪/৫ টা কুকুর অনেকদিন ধরেই তাদের মতো করে একটা কম্যুনিটি বানিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিনই তারা রাতের বেলায় মিটিং করে নিজেদের মধ্যে, মিটিং শেষে তারা বেশ কিছুক্ষণ করুণ সুরে চিৎকার করে কার কাছে যেন অভিযোগ, অনুযোগ ও প্রার্থনা জানান দেয় সম্ভবত। ইদানীং কেমন যে শিরশিরে অনুভুতি চলে আসে তাদের এমন অদ্ভুত করুণ চিৎকারে। এতোদিন এটা খেয়াল করা হতো না তেমন। যদিও এই বেলকনিতে, এই চেয়ারে বসে, গ্রীলের রডে পা দুটো ঝুলিয়ে মনের সকল আবেগ নিয়ে ভালোবেসেছি, তীব্রভাবে দুজন দুজনকে নিয়ে হারিয়ে যেতাম তেপান্তরের শ্যামল মাঠে, কাশবনের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে তার প্রতি প্রবল মুগ্ধতা নিয়ে কাটিয়ে দিতাম স্নিগ্ধ প্রহরগুলো। তখন আমার সুসময় ছিলো, প্রতিটা রাত ছিলো একাদশীর মতো উজ্জ্বলতায় ভরপুর।

তখনো এই কুকুরেরা এভাবেই আর্তচিৎকার করতো। ফোনের ওইপ্রান্ত থেকে সে বলতো তোমার এখানে এতো কুকুর ডাকে কেন? তুমি কোথায়? এভাবে কেন ডাকছে তারা? এমন অনেক প্রশ্ন ছিলো যার উত্তর একদম হালকাভাবেই দিয়ে দিতাম। কারণ ওই প্রান্তের মানুষটার জন্য যতটা গভীরতা ছিলো নিচের হতদরিদ্র সারমেয়দের জন্য ততটা ভাবনাও ছিলো না। তাই তাদের আর্তনাদ আমাকে টাচই করতো না। এটাকেও তাদের রোজকার বৈশিষ্ট্য ভেবেই গভীর প্রেম নিয়ে ডুব দিতাম কয়েকশত মাইল দূরে থাকা সেই পাগলিটার কণ্ঠে, যার কণ্ঠ আমাকে টেনে নিয়ে যেত কোন এক তীব্র আলোয় ঝলমলে করা সেই ছায়াঘেরা রোডটিতে যে রোডে তার হাত ধরে আমি হাটবো বলে পণ করেছি।


দুরত্ব যা ছিলো তা শুধুই কিলোমিটারের, এর বাইরে দিনের প্রতিটি মুহুর্ত আমরা একইসাথে কাটিয়ে দিয়েছি। তার জন্যই নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে করা আমি আজ বড্ড সুখের অভাবে আছি। যাকে হাজারটা নামে ডেকেছি মায়াভরে, প্রানভরে সেই মানুষটাই তার নাম ধরে ডাকতেও নিষেধ করে দিয়েছে, যদিও অনেকটা বেহায়া বলেই আমি তার নাম ধরে ডাকি মাঝে মাঝে, তবে তাতে আর সেই আগের নামটা, আগের এই নামের মানুষটাকে পাওয়া হয় না, হয়তো পাওয়া হবে না কখনোই। যে মানুষটা সবভাবে থেকেও কোনভাবেই না থাকার অভিনয় করে তাকে হাজার খুজেও আর পাওয়া হয় না। প্রতিটা রাতেই ঘুরতে থাকি টাইম মেশিনের ককপিটে চড়ে। ফিরে যাই সেইসকল ভালোবাসাময় দিনগুলোতে, ভিতরে কেমন যেন অস্বাভাবিক শূন্যতা ভর করে। জোৎস্নারাতও অমাবস্যার মধ্যরাতের মতো মনে হয়। কেমন জানি কৈশোরকালীন অপরিণত চিন্তাভাবনার মতো মনে হয়।

অথচ আমি কৈশোর পেরিয়েছি প্রায় এক যুগ আগেই। আমার এমন আচরণ দেখে বা শুনে সেও মাঝে মাঝে এটা মনে করিয়ে দিতে ভুলে না যে আমি কোন কিশোর নই। আমিও বুঝতে পারি আমি তো কিশোর নই, কিন্তু নিউরনগুলো কেমন জানি!! তারা আমার খেয়ে, আমার পড়ে আমাকে কোন পাত্তাই দিচ্ছে না। কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে সব। হুট করেই নিজের ভিতরেও একটা করুণ সুর অনুভব করলাম, কেমন জানি হু হু করে ডেকে যাচ্ছে অর্থহীন সুরে। ঠিক সেই মুহুর্তেই নিচের কুকুরদের সেই আর্তির অর্থ খুজে পেলাম বলেই মনে হলো। ছোটবেলায় মা-খালাদের মুখে শুনতাম কুকুর নাকি অশরীরী ছায়া দেখতে পায়, অশরীরী ভাষা শুনতে পায়। তাই তাদেরকে তাড়িয়ে দেবার জন্যই নাকি তারস্বরে চিৎকার করে যাতে অশরীরী কেউ শরীরী কারো ক্ষতি করতে না পারে। অনেকটা একলব্যের ভূমিকা পালন করে এই শুকনো জিরজিরে নেড়ি কুকুরগুলো। তখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে যখন কুকুরদের এমন কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম তখন আলিফ লায়লার বিকটদর্শন জ্বিনদের চেহারা মনে হয়ে ভয়টা আরো তীব্র হয়ে উঠতো। মনে হতো এই বুঝি কোন জ্বিন আমাকে ধরে নিয়ে যাবে শূন্যে ভাসিয়ে অজানা কোন দেশে। আর আজ নিজের ভেতরের আর্তনাদ আর তাদের কান্নার সুরে অদ্ভুত এক মিল বুঝতে পেরে মনে হলো কতোটা তীব্র বেদনায় এমন চিৎকার করতে পারে কোন প্রানী।

প্রিয় মানুষ চলে গেলে একসময় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, মেনে নিয়ে নিজের মতো করে চলতেও শিখে যাই এক সময়। কিন্তু যে মানুষটা চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও  হারিয়ে ফেলার অনুভুতি ছড়িয়ে দেয়, সেই কষ্ট মেনে নিয়ে জীবনটা যাপন করা কতটা কঠিন তা আমার ভেতরের আর্তচিৎকারের মতোই দুর্বোধ্য সবার কাছে। এমনকি নিজের কাছেও দুর্বোধ্য মনে হয়। শত মাইল দূরে সেও ভালো নেই বুঝতে পারি, নিজেদের দুর্ভাগ্য নিয়ে দুই প্রান্তে কষ্টযাপন করে মানুষেরা বড্ড ভুল সময়ে সঠিক মানুষের সন্ধান পায়। কিন্তু একসময় এই সন্ধান পাওয়াটাই অভিশাপ মনে হয়। আলোকবর্ষ দুরত্বে থেকেও মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকতে পারলেও মানুষ যখন তার স্বপ্ন মুছে যাওয়ার হুমকিতে পড়ে ঠিক তখনই মাত্র কয়েক ঘন্টাও তখন মহাকাল হয়ে যায়, কয়েকশো কিলোমিটারও তখন আলোকবর্ষ হয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *