সাংবাদিকতার একাল সেকাল

আমাদের মাখন কাকা, সবার কাছেই তিনি মাখন কাকা নামে পরিচিত। উনার চেহারা সুরত কিন্তু আবার মাখনের মত ভাবতে যাবেন না, উনি গড়ে পড়তায় দুধের পুড়ে যাওয়া সরের মতো হতে পারেন আর কি। তবে নামে আর চেহারার মাঝে পার্থক্যের জন্য উনাকে কখনো দুঃখবোধ করতে দেখা যায় নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় তিনি তার নামসর্বস্ব অনেক দৃষ্টিনন্দন ব্যানার, ফেস্টুন টানিয়ে রাখেন নিজের চেহারা মুবারাক এডিট না করেই। বুঝতেই পারছেন তিনি নামে নয় বরং নামটাকে জায়গামতো ঝুলাতে পেরেছেন কি না এবং তা সকলের না হলেও গরিষ্ঠের অক্ষির গোচরে এসেছে কি না সেটা নিয়েই ভাবতেন। আবার নামের আগে পিছে বিভিন্ন নাম না জানা, অর্থ না বুঝা অনেক পদ-পদবীর পাইকারী বাজার বসাতে ব্যাপক আগ্রহ উনার। আমার খুবই ইচ্ছে হয় উনার সাথে একদিন কথা বলি কিন্তু সাহসে কুলোয় না। পয়সাওয়ালা মানুষদের কেন জানি আমার মানুষ মনে হয় না, এদেরকে আমার অতিমানুষ মনে হয়। কিন্তু একদিন অদ্ভুতভাবে উনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে গেলো। উনি রাস্তা ধরে হাটতেছিলেন আর আমি উল্টা পথে উনার মুখোমুখি হতেই উনি আমাকে বললেন এই যে ছেলে লেখাপড়া কিছু করো নাকি? আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াতেই উনি আবারও প্রশ্ন করে বসলেন, “তা তুমি বড় হলে কি হবে??” আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম আমাদের মাখন কাকা আমাকে এই প্রশ্ন কেন করলো? টেনশনে কথাই বের হতে চাচ্ছে না দাত-মুখ ভেদ করে। এটা হবো, ওটা হবো বলতে গেলে প্রশ্নের আকার-আকৃতি ও সংখ্যা বাড়তে পারে ভেবে আমি যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক উনাকে জানালাম যে “মাখন কাকা আমি আসলে বড় হতেই চাই না!!”

উনি আমার দিকে তাকালেন, তাকানোর স্টাইলটা পৌষ মাসের পুকুরের পানির মতো শীতল নাকি চৈত্রের মধ্য দুপুরের গনগনে সূর্যের মতো সেটা বুঝতে না পারলেও উনার চোখটা অনেকটা পাকিস্তানি বাসমতী চালের মতো সরু হয়ে আসলো সেটা বুঝতে পারলাম। উনার চোখের এই আপাত বাহ্যরূপে দেখে আমি তো পুরাই ডিপ ফ্রিজে চলে গেলাম। এখন কি হবে? দৌড় দিবো নাকি? এসব ভাবতে ভাবতেই মাখন কাকা চমৎকার একটা হাসি দিয়ে উঠলেন আর তখনি মাখন কাকার নামের স্বার্থকতা ফুটে উঠলো। উনার হাসিটা তখন মাখনের মতোই লাগছিলো। উনি হেসে বললেন তোমার উত্তরটা ভালো লেগেছে। চলো তোমাকে কিছু খাওয়াই। ভাবলাম যেহেতু খাওয়ার অফার পেয়ে গেলাম তাহলে মনের মধ্যে রাখা কিছু উশখুশ করা প্রশ্নের জবাব নিয়াই নেই। আমি বললাম চাচা আমি কিছুই খাবো না তবে আপনাকে কয়টা প্রশ্ন করবো! মাখন চাচা পিঠে মাখনের মতো একটা চাপড় দিয়ে বললেন কথা মন্দ বলো নাই, খাওনের সময় কথা বলা ঠিক হবে না। তা বলো কি প্রশ্ন করবা? বললাম কাকা আপনি সবসময় কাজী হায়াতের সিনেমা দেখেন কেন? উনি কয়েকবার কাজী হায়াত বলে আঙ্গুলে চুমু দিয়ে চোখে লাগিয়ে নিয়ে উপরে তাকালেন। তারপর সম্মানের সহিত দাঁড়িয়ে বললেন আসলে উনার ছবিতে সৎ পুলিশ আর সৎ সাংবাদিকের দেখা পাওয়া যায় তাই দেখতাম। আবার সিনেমাতে তাদের দুর্দশা দেখে তাদের প্রতি একটা ভালোবাসাও কাজ করতো। ফাঁকতালে অবশ্য একটা গোপন কথাও বলে দিলেন, উনি নাকি এক সময় সৎ পুলিশ বা সৎ সাংবাদিক (যা হতে পারেন আর কি!!) হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধি পুরাই উল্টো ছিলো বলে পরীক্ষায় রেজাল্ট কামাই না করে প্রচুর টাকা কামাই করলেন। ফলে পয়সাওয়ালা ছাড়া কিছুই হওয়া হলো না।

আমি উনাকে স্বান্তনা দিলাম, বললাম কাকা পুলিশ হন নাই ভালো হইছে। এরা খারাপ করলেও গালি খায় ভালো কাজ করলেও গালি খায়। পাবলিক তাদের দুধভাত মনে করে। হাজার কাজ করলেও জনগণ সুযোগ পাইলেই পিন্ডি চটকায়। আর সাংবাদিক!!  আল্লাহ বাঁচাইছে কাকা, আপনি সাংবাদিক হোন নাই। অবশ্য এখনো অনেক ভালো সাংবাদিক আছেন। তবে সুরতে আর হালতে যা মনে হচ্ছে এভাবে চললে আর দশক কয়েক পরেই যাদুঘরে গিয়ে বড়বড় সাংবাদিকদের ছবি দেখে আসতে হবে। কাকা চোখ এবার গোল করলেন, জিজ্ঞেস করলেন পুলিশেরটা না হয় বুঝলাম যে পাবলিক তাদের গরীবের বউ মনে করে। তয় সাংবাদিক কি করলো? আমি বললাম চাচা আছেন কোনদেশে আপনি? খবর কি কিছু রাখেন? আজকাল সাংবাদিক খবর লেখে না নিজেরাই খবর হয় আবার তা নিজেরাই নিজেদের পত্রিকায় প্রকাশ করে। চাচা এবার ধন্দে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ থ মেরে থেকে জিজ্ঞাসিলেন, ঠিক করে বলো তো বাবা নিজেরাই খবর, নিজেদের পত্রিকা এসব তো বুঝতেছি না। আমি বললাম আমাদের সাথে যারা এসএসসি পাশ দিতে পারে নাই তারা এখন পত্রিকা চালায়,পত্রিকার সম্পাদকও আছে। অথচ এককালে ক্লাসে নিজেদের হোমওয়ার্কও সম্পাদনা করতে পারে নাই তারা। বুঝেন এবার সাংবাদিকতা এখন কেমন খালার(পড়ুন মেসের খালার) হাতের মোয়া হয়ে গেছে!


মাখন কাকার চোখ হঠাৎ করেই চকচক করে উঠলো, তিনি মাথাটা আমার কাছাকাছি নিয়ে আসলেন আরেকটু, বললেন বাবা এই লাইনে তোমার কোন জানাশোনা আছে নাকি? মানে আমার সার্টিফিকেট না থাকলেও স্কুলের বারান্দা পার হয়ে ক্লাসরুমে তো গিয়েছিলাম তাই না? আমি কি একটা পত্রিকার সম্পাদক হতে পারি না? মানে তুমি যদি একটু সাহায্য কর‍তে আর কি!! আমি কিছু না বলে চাচাকে সালাম দিয়ে চলে আসলাম, যদিও চাচা এটাকে বেয়াদবি মনে করছেন কি না জানার সুযোগ নিতে পারি নি। হায়েনার চোখের দিকে তাকানো গেলেও মাখন চাচার এই মুহুর্তের চোখের সামনা নেবার মতো বুক থাকলেও পাটা আমার ছিলো না। 

দুইদিন পর বাজারের রাস্তা দিয়ে হাটছি, হুট করেই বড় শিলকড়ই গাছের বুকে পেরেক ঠুকে দিয়ে ঝুলে থাকা একটা বোর্ড দেখে থমকে গেলাম। মাখন চাচার ছবি, কিন্তু বিশেষত্ব হলো এই ছবিতে উনি একটা দামি পার্কার কলম উচিয়ে ধরে আছেন। পাশে ক্যাপশন আকারে লেখা আছে ”ওসির ছেয়েও মুসী বরো”। এই বয়সে হার্ট অ্যাটাক দৃষ্টিকটু দেখায় বলেই কি না হৃদযন্ত্রের পাম্প কাজ করা থামায় নি। না হলে “অসির চেয়েও মসি বড়’র এই হাল দেখেও হৃদপিণ্ড যে গলা বরাবর লাফ দেয় নি এটাই এক বিরাট ক্যালমা।

মাখন চাচা এবার নামের সাথে সাংবাদিক শব্দটাও ঝুলিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, তবে সাংবাদিকতায় কি যে বুলিয়ে দিবেন তা কেবল উনার www.makkhon24×7×360degree.horizon এর ভুলকালাম থুড়ি তুলকালাম দেখেই মহাবিশ্ববাসী জেনে যাবেন খুব শীঘ্রই। (নামটা জোশ না?)

তাড়াতাড়ি পত্রিকার ফেসবুক পেজে লাইক দেবার জন্য  ফেসবুকে ঢুকতেই একটা মিমে তে চোখ পড়লো। একজন কালো করে মোটামুটি বয়স্ক ক্লিন শেভড মাংসে ভরা গালের অধিকারী একজন ব্যক্তি দুই আঙ্গুলের ফাকে সিগারেট ধরে কাউকে কিছু বলছেন ভঙ্গিমার ছবির ক্যাপশনে দেয়া আছে “৫  ট্যাখার ঝালমুড়ি দেও বা, ঝাল বাড়াইয়া দিও”
ছবির লোকটাকে আমি চিনতে পেরেছি কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না, এককালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন!!
কি যেন নামটা??

বি:দ্র: কাউকে ছোট করার উদ্দেশ্যে নয়, আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে সাংবাদিক বনে যাওয়াদের বেশিরভাগই মাখন কাকার মতোই। সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পন বলা হয়। তাহলে সাংবাদিক হলো সেই মহান পেশার কর্মী যারা এই দর্পনকে প্রতিনিয়তই সমাজের আরো পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে ও প্রকৃত প্রতিচ্ছবি প্রদর্শন করার উপযোগী করে গড়ে তুলবে, এগিয়ে নিবে।
সকল সংবাদকর্মীদের(যোগ্যতাসম্পন্ন) প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা!!
 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *