বিশ্রামের রকমফের ও কোভিড পরবর্তী মানসিক পূনর্গঠন

আপনি কি টানা ঘুমিয়ে কিংবা ঘুমের মাধ্যমে বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্তি দূর করার জন্য অনেক সময় নিয়ে ঘুমিয়ে শারিরীক ও মানসিক শক্তির ঘাটতি ঠিক করার চেষ্টা করার পরেও কি অবসন্ন বোধ করছেন?

যদি আপনি এটাই হয়ে থাকেন তাহলে জেনে নিন ঘুম আর বিশ্রাম একই জিনিস নয়, যদিও আমাদের বড় একটা অংশ এই দুটো বিষয় গুলিয়ে ফেলি বা বিভ্রান্ত হই।

আমরা যে জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেখানে ধরে নিচ্ছি যে আমরা বিশ্রাম নিয়েছি বা পাচ্ছি কারণ আমরা পর্যাপ্ত ঘুম পেয়েছি – কিন্তু বাস্তবে আমরা আল্টিমেট বিশ্রামটা হারাচ্ছি যা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন।  ফলাফল হল আমরা উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছি, দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্লান্ত এবং মানসিকভাবে ফিকে হয়ে যাওয়া ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছি। এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো আমরা বিশ্রামের ঘাটতিতে ভুগছি কিন্তু বিশ্রামের প্রকৃত শক্তি বুঝতে পারছি না।

বিশ্রামের স্বরূপ অন্বেষণে আমরা সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রামের ধরণ নিয়ে আলোচনা করবো।

১. আমাদের প্রথম যে ধরনের বিশ্রামের প্রয়োজন তা হলো শারীরিক বিশ্রাম, যা প্যাসিভও হতে পারে আবার বা এক্টিভও হতে পারে। প্যাসিভ শারীরিক বিশ্রামের মধ্যে শুয়ে থাকা এবং ঘুমানো অন্তর্ভুক্ত, অপরদিকে এক্টিভ বা সক্রিয় শারীরিক বিশ্রাম মানে হলো যোগব্যায়াম, স্ট্রেচিং এবং ম্যাসেজ থেরাপির মাধ্যমে শরীরের অঙ্গ ও রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে পেশি ও হাড়ের নমনীয়তা পুনরুদ্ধার ও উন্নত করতে সাহায্য করে ও শরীরের বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তার প্রাধান্য দিতে প্রলুব্ধ করে।

২. দ্বিতীয় প্রকারের বিশ্রাম হল মানসিক বিশ্রাম।  আপনি আপনার আশেপাশে অনেককেই দেখবেন যিনি দিনটা শুরু করেন এক কাপ কফি দিয়ে। কিন্তু সেই একই ব্যক্তি প্রায়শই খিটখিটে আচরণ করে, কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না কিংবা কাজের প্রায়োরিটি ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থার সম্মুখীন হন। তিনি যখন রাতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন তখন তার মস্তিষ্ককে শান্ত করতে সংগ্রাম করতে হয় এবং প্রায়ই সেটা করতে গিয়ে মস্তিষ্ক আরো উত্তপ্ত হয়, ফলাফল শুয়ে থাকা-ই সার, ঘুম আর আসে না। এর কারণ হলো দিনের পুরোভাগে যে খিটখিটে মেজাজ, রেগে থাকা, বসের ঝাড়ি খাওয়া, অধীনস্থদের সাথে উত্তাপ ছড়ানো সম্পর্কের যে প্রভাব তার প্রতিক্রিয়া। তিনি যখন ঘুম থেকে উঠেন এমনকি তা সাত আট ঘন্টা ব্যাপ্তির হবার পরেও তিনি এমনভাবে জেগে উঠেন যেন তিনি একটুও ঘুমান নি।  অর্থাৎ মানসিক প্রশান্তি থেকে অনেক দূরে বসবাস করছেন, মানসিক বিশ্রামের ঘাটতি থেকে তিনি বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

ভাল খবর হল এটি ঠিক করার জন্য আপনাকে আপনার চাকরি ছাড়তে হবে না বা ছুটিতে যেতে হবে না।  আপনার কর্মদিবস জুড়ে প্রতি দুই ঘণ্টায় সংক্ষিপ্ত বিরতির সময় নির্ধারণ করুন;  এই বিরতিগুলি আপনাকে বিশ্রামের ঘাটতি পূরণ করার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে।

৩.  তৃতীয় যে ধরনের বিশ্রাম আমাদের প্রয়োজন তা হলো স্নায়বিক বিশ্রাম। আমাদের যে বিভিন্ন স্নায়বিক অঙ্গ রয়েছে যেমন চোখ, কান, নাক, মুখ, ত্বক এসবেরও বিশ্রাপ প্রয়োজন। প্রশ্ন আসতে পারে এদের তো আলাদা করে কায়িক শ্রম করতে হচ্ছে না তবে তাদের আবার নিয়ম করে বিশ্রাম দিতে হবে নাকি? উত্তর হলো হ্যাঁ, দিতে হবে।  উজ্জ্বল আলো, কম্পিউটার স্ক্রীন, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ এবং একাধিক কথোপকথন – সেগুলি অফিসে হোক কিংবা অফিসের বাইরে অথবা জুম মিটিংয়ে কিংবা ফোনকলে যেভাবেই হোক না কেন তা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে ক্লান্ত করে তুলতে পারে৷ আর তাই এসব অঙ্গের জন্যেও আলাদা করে বিশ্রাম প্রয়োজন। যদিও তা খুব কঠিন কাজ নয়, দিনের বিভিন্ন ভাগে  কয়েক মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করা, নিরবতা পালন করা, কোন কথা না বলার  মতো সহজ কিছু কাজ করার মাধ্যমে এবং সেইসাথে প্রতিদিনের শেষে ইচ্ছাকৃতভাবে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে এই বিশ্রামটি গ্রহণ করা যেতে পারে।



৪. চতুর্থ প্রকারের বিশ্রাম হল সৃজনশীল বিশ্রাম।  এই ধরনের বিশ্রাম সবার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের সবাইকেই সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আবার তার সমাধান করতে হয় বা নতুন ধারণা নিয়ে চিন্তা করতে হয় বলেই সবারই সৃজনশীল চিন্তা যেমন করতে হয় তেমনি সৃজনশীল বিশ্রামও নিতে হয়। যা আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে জীবনকে উপভোগ করার পাশাপাশি এবং জীবন নিয়ে বিস্ময়কে পুনরায় জাগিয়ে তোলে।  আপনার কি প্রথমবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, হিমালয় পর্বত বা নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখার কথা মনে আছে? মনে থাকলে অবশ্যই সেদিনের নিজের ভেতরের বিস্ময় ও অবাক হয়ে বাইরের সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার স্মৃতি মনে পড়ছে। বাইরের সৌন্দর্য দর্শন আপনাকে এই বিশ্রাম দেবে, মনকে চাঙ্গা করবে, নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণা দেবে। ভ্রমণ আপনাকে সৃজনশীল বিশ্রাম প্রদান করে, তাই পরিব্রাজক হোন, নতুন কিছু জানুন, শিখুন, এগিয়ে যান।

কিন্তু সৃজনশীল বিশ্রাম কেবল প্রকৃতি দর্শনই না এখানে আপনার অবশ্যই শিল্পকলাকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আপনার পছন্দের স্থানের ছবি এবং আপনার সাথে কথা বলে এমন শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে আপনার কর্মক্ষেত্রকে অনুপ্রেরণার জায়গায় পরিণত করুন।  আপনি সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা ফাঁকা বা এলোমেলো পরিবেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবেন না এবং এটা আপনার ভেতরে কোন বিষয় নিয়ে পরিশীলিতভাবে উউদ্দীপনা তৈরি করবে এমনটা আশা করতে পারবেন না, আপনার উদ্ভাবনী ক্ষমতা কমে যাবে, উদ্ভাবনী ধারণা হ্রাস পাবে।

৫. এ ধরনের বিশ্রামের ব্যাখ্যায় যাবার পূর্বে একজন ব্যক্তিকে কল্পনা করা যাক, যিনি খুবই নির্ভরশীল একজন মানুষ যার উপর তার বন্ধুরা নির্ভর করে এবং সাহায্যের প্রয়োজন হলেই সবাই যাকে মনে করে। কিন্তু এই মানুষটির যখন মানসিক বিশ্রাম বা প্রশান্তি দরকার হয় তখনো সবাই তার মিথ্যে প্রশংসা করে, বাগাড়ম্বর করে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে অর্থাৎ তার কাছে ইতিবাচক সান্নিধ্য ও অনুগ্রহ লাভের আশায় মিথ্যে বলে তার প্রকৃত অবস্থা পরিবর্তনে সাহায্য না করা।
এসব পরিস্থিতিতে ব্যক্তির যা দরকার ছিলো তা হলো পারিপার্শ্বিক অবস্থার সংবেদনশীলতা। পরিবার ও বন্ধুমহলের কাছ থেকে আরো বেশি সংবেদনশীল আচরণ পাওয়া দরকার ছিলো কিন্তু তিনি তার বিপরীতটা পেলেন। এক্ষেত্রে তিনি সংবেদনশীল বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত হলেন।
এই ব্যক্তির সংবেদনশীল বিশ্রামের প্রয়োজন, যার অর্থ হলো আপনার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য সময়, স্থান ও প্রকৃত কিছু বন্ধু আছে যাদের কাছে অবাধে যেকোন সময় ও স্থানে আপনি আপনার অনুভূতি ব্যক্ত করার পাশাপাশি সংবেদনশীল বিশ্রামের ঘাটতি পূরণ করে নিতে পারেন। অর্থাৎ প্রকৃত শেয়ারিং ও কেয়ারিং এনটিটির উপস্থিতি ও তার কাছ থেকে উপযোগ নিতে পারার সুযোগ থাকা মানেই হলো আপনার সংবেদনশীল বিশ্রাম নিতে সমস্যা হচ্ছে না বা হবার কথা নয়।

৬. আপনার যদি মানসিক বিশ্রামের প্রয়োজন হয় তবে সম্ভবত আপনার সামাজিক বিশ্রামের ঘাটতিও রয়েছে। এই বিশ্রামের ঘাটতি তখনই ঘটে যখন আমরা আমাদের স্থিতিশীল সম্পর্কগুলির মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হই এবং তা আমাদের সেইসব সম্পর্কগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে যারা উল্টো  আমাদের মানসিকভাবে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত করে। তাই সামাজিক বিশ্রামের অভিজ্ঞতা পেতে হলে, নিজেকে ইতিবাচক এবং সহায়ক ব্যক্তিদের সাথে ঘিরে রাখুন।  এমনকি আমাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াগুলোকে  ইতিবাচকভাবে কার্যকর করে তুলতে হলে প্রয়োজনে নিজের জন্য উপকারী বন্ধু কিংবা অন্যান্য ব্যক্তিদের বেছে নিতে হবে। আত্মবিচার একটা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কোন ব্যক্তি আপনার জন্য ভালো বা মন্দ তা নিজেকেই বিচার বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে এবং তাদের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টার মাধ্যমে নিজেকে সামাজিক বিশ্রাম দেবার প্রয়াস নিতে হবে।

৭. বিশ্রামের চূড়ান্ত প্রকার হল আধ্যাত্মিক বিশ্রাম, যা শারীরিক এবং মানসিক বিশ্রামের বাইরে সকল সংযোগ স্থাপন করার ক্ষমতা অর্জন এবং আত্মীয়তা স্থাপন ও রক্ষা, ভালবাসা, গ্রহণযোগ্যতা এবং ইতিবাচক উদ্দেশ্য অনুভব করার ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে এই বিশ্রাম অত্যন্ত কার্যকরী।  এটি পেতে নিজের থেকেও বড় কিছুতে নিযুক্ত হওয়া এবং দৈনন্দিন রুটিনে প্রার্থনা, ধ্যান বা নিজ সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই বিশ্রাম লাভ ত্বরান্বিত করা যায়।

সবশেষে এটা পরিষ্কার একা ঘুম আমাদের বিশ্রামের চুড়ায় ফিরিয়ে আনতে পারে না।  তাই সময় এসেছে আমাদের প্রয়োজনীয় সঠিক ধরনের বিশ্রাম পাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করা এবং শরীর ও মন উভয়ের কার্যকর বিশ্রাম পূরণ করার চেষ্টা করা। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *