মাৎস্যান্যায় নিয়ে চাণক্যের ফিরে আসা

কি এক আদিম নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছি সবাই!! চাণক্যের লেখা ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে’- ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে একটা সংস্কৃত শব্দ আছে যার অর্থ হলো মৎসের ন্যায়। সোজা কথায় বড় মাছ কর্তৃক ছোট মাছকে সাবাড় করার যে প্রাকৃতিক নিয়ম আছে সে নিয়মে মনুষ্য সমাজেও বড় কর্তৃক ছোটকে ভোগে পাঠানোর এই অমানবিক বিষয়কর্ম দেখেই জনাব চাণক্য মহাশয় এই শব্দের ব্যবহার করেন। প্রাচীন কালে অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের মাঝে স্পষ্টতই ক্ষমতার চরম পার্থক্য ছিলো, ফলে পুরো সমাজব্যবস্থা মাছেদের সমাজের মতোই ছিলো। কিন্তু বর্তমান সময়ে কার বেশি ক্ষমতা বা জোর সেটা বুঝার উপায় নেই। কে কাকে মারছে, কেন মারছে, কিভাবে মারছে তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। প্রতিটা সমাজেই ন্যায়-অন্যায় পাশাপাশি থাকে, যদিও এই দুটো প্রপঞ্চের মাঝে মাত্রার পার্থক্য থাকতেই পারে, তবে মনুষ্য বিবেচনায় আমরা ভেবেই নিতে পারি যে মানবিক গুণাবলীর কারণেই আমাদের সমাজে অন্যায়ের চেয়ে ন্যায়ই প্রবল ক্ষমতাশালী হবে। কিন্তু না, দাবার দান উল্টে যাচ্ছে অথবা ইতোমধ্যে উল্টে গেছেই হয়তো বা। বড্ড বেশি অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি, চরম লোভী হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের লোভ অন্যের উপর, আমরা শুধু নিজেদেরই সহ্য করি, আমাদের থাবা সিংহের থাবার চেয়ে বিভৎস আর ভয়ংকর হয়ে উঠছে দিনদিন। ভাবা যায় পুরো মানবজাতি যেখানে হাবুডুবু খাচ্ছে সুক্ষ্ম ভাইরাসের আক্রমণে। সেখানে আমরা নিজেরাই ভয়ংকর ভাইরাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। আমাদের ভেতরটায় প্রবল সংক্রমণ হয়েছে, অমানবিকতার সংক্রমণ, জুলুমবাজীর সংক্রমণ, মিথ্যে আর অবিমৃষ্যকারিতার সংক্রমণে আমরা ক্রমশ মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলছি। যে স্রোত একসময় চোরা স্রোত ছিলো সেখানেই আজ প্রবল বিধ্বংসী এক বাণ এসেছে। ভাবা যায় মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য একজন মানুষকে আমরা মেরে ফেলতে পারি, যদিও ঘটনা কি তা প্রমানসাপেক্ষ বিষয়, তবুও অত্যাচার করে যে মেরে ফেলা হয়েছে তা তো দিনের আলোর মতোই পরিস্কার। আবার দেখুন একটা ১২ বছরের মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে বেশ কয়েকজন বীরপুঙ্গবদের টেস্টোস্টেরনের উপযোগ পরীক্ষা করলো। ভাগ্যিস পিচ্চি এই মেয়েটাকে তারা ছেড়ে দিয়েছিলো, চাইলে এই অমানুষের দল এই মেয়েটাকে কিমা, কাবাব বানিয়ে খেয়ে নিলেও কেউ খোজ পেতো না হয়তো। এই দুইটা ঘটনাকে শুধু গতকালের হাইলাইটস বলা যেতে পারে। একটা আমার জন্মস্থান সিলেটে, আরেকটি আমাদের সুপ্রাচীন রাজধানীতে ঘটেছে। এসব হলো সমাজে নৈরাজ্যের মোটামুটি একটা চিত্র।


তবে আমি হতাশ হই, খুবই হতাশ হই। বলা যায় আমার মনোবল, আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় যখন দেখি একটা বড় অংশ আবার এসব নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আ উল্টো বাতাস দিতে থাকে, ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে সরকার পতন চায়। সরকার পতনের সাথে ধর্ষণের বিচারের সম্পর্ক আমি কোনভাবেই খুজে পাই না, মিলাতে গেলেও লেজেগোবরে হয়ে যাই। মানলাম সরকার ব্যর্থ, সরকার তার জনগণের নিরাপত্তা বিধান, মৌলিক ও অপরাপর অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। তাহলে আপনারা এটা নিয়ে আলাদা আন্দোলন করেন, আরো জোরালো আন্দোলন করেন। কিন্তু রাস্তায় নেমে ধর্ষণের বিচার চেয়ে এমন অদ্ভুত দাবী করে পক্ষান্তরে আপনি ধর্ষিতার দাবিকে অস্বীকার করে নিলেন, অথচ আপনার আমার আন্দোলন দেখে কাছে সেই মেয়েটি ও মেয়েটির পরিবার হয়তো ভেবেছিলো যাক এবার জনগণ ক্ষেপেছে, একটা কিছু বিচার না করে কেউ পার পাবে না। কিন্তু না, মেয়েটা ভুল ছিলো, ভুল ছিলো অই মধ্যবয়সী বিবস্ত্রা গৃহবধূও, এমনকি ভুল ছিলো স্বামীর সাথে ঘুরতে বেড়ানো মেয়েটি, ভাইয়ের সাথে ঘরে ফেরার পথে থাকা স্বপ্নালু ছোটবোনটিও।
আসলেই অদ্ভুতুড়ে সব ভুতে সয়লাব হয়ে গেছে প্রতিটি ঘরের চালা, প্রতিটি ছাদ, প্রতিটি বারান্দা। কোথাও নিরাপদ নন আপনি, লিটারালি আপনি কোথাও নিরাপদ নন। আপনি সমাজের কেউকেটা আদমি? অহ নো ম্যান, ল্যাম্পপোস্টের নিচেই আপনাকে হাওয়া করে দেবে ভুতের দলেরা, অথচ ল্যাম্পপোস্টে লাগানো ছিলো হাজার ওয়াটের সোডিয়াম লাইট।

১৩/১০/২০২০

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *