প্রেম অপ্রেমের নৈবেদ্য

‘আধ্যাত্মিক সাধনা কখনোই রূপের সাধনা হইতে পারে না। তাহা সমস্ত রূপের ভিতর দিয়া চঞ্চল রূপের বন্ধন অতিক্রম করিয়া ধ্রুব সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করে। ইন্দ্রিয়গোচর যে কোনো বস্তু আপনাকেই চরম বলিয়া স্বতন্ত্র বলিয়া ভান করিতেছে, সাধক তাহার সেই ভানের আবরণ ভেদ করিয়া পরম পদার্থকে দেখিতে চায়।’ (রূপ ও অরূপ)।

এখানেই প্রেম তার প্রকৃত চরিত্রে আবির্ভূত হয়, প্রেম তার বৈশিষ্ট্য দিয়েই সাধনার কিয়দংশ দখল করে নেয় আর তাই প্রেমে নিবদ্ধ হয়ে গেলে রূপের ঘটা আর চোখে পড়ে না, যেখানে চোখ নিজেই প্রেমে ভাসে আর ডুবে সেখানে রূপ তো নিছকই একটা প্রপঞ্চ যা বড়জোর প্রেমের নৈবেদ্যের ডালা সাজিয়ে তুলতে পারে কিন্তু সাধক বলুন বা প্রেমিক সে তো তার হস্তকে ডালা বানিয়ে প্রেম দিয়েই নৈবেদ্য ঢেলে দেয় প্রেমময়ীর চরণে।

‘আধ্যাত্মিকতায় আমাদের আর কিছু দেয় না, আমাদের ঔদাসীন্য আমাদের অসাড়তা ঘুচিয়ে দেয়। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই তাঁর আনন্দরূপ।’ (শান্তিনিকেতন)।

আধ্যাত্মিকতা বা শাশ্বত প্রেমের এই সাধনা যদি শুধুই এমন রূপের ঘেরাটোপে ঘুরে বেড়াতো তাহলে এটা কখনোই পার্থিব শূন্যতাকে অপার্থিব পূর্ণতা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারতো না।



বেশিরভাগ প্রেমের ক্ষেত্রেই আমরা ভালবাসা বা জয় করার মাঝে পার্থক্য করতে পারি না। যখন কাউকে ভালো লেগে যায় তখনই তাকে নিজের করে পেতে যারপরনাই উঠে পড়ে লেগে যাই আমরা। অথচ তার আগে আমাদের বুঝা উচিৎ যে ঐ মানুষটিকে আমি ভালবাসি বলেই বা সারাজীবন ভালবাসবো বলেই পেতে চাই নাকি তাকে অন্যের হতে দেখতে পারবো না বলেই নিজের দখলে নিতে চাই? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা প্রেম বা ভালবাসায় পরিপূর্ণ একজন মানুষকে পেয়ে তার প্রতি নিজের অনুভূতি, ভালবাসার আকুতি, তার ভেতরের তাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করা, তাকে ধরে রাখার নিরন্তর পরিবর্তনশীল প্রয়াসে সকল প্রেমময় অনুভুতিগুলোকে এক নতুন বাঁক দিয়ে হলেও আত্মিক প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়ে যেতে চাই প্রতি মুহুর্তে। এটাই প্রেমের আধ্যাত্মিকতা, হতে পারে মানব প্রেম, ইশ্বর প্রেম এমনকি প্রেয়সীর প্রেমেও সেই আধ্যাত্মিকতা ধরা দেয় অপার সৌন্দর্য নিয়ে।

আবার  ওই মানুষটাকেই কখনো কখনো আর আগের মতো চকচকে, ঝলমলে মনে হয় না। কেমন জানি ভেতর থেকে আর একসাথে পথচলার তাগিদ আসে না বা কোনরকমে দায়বদ্ধতা বা নিছকই ঘাড়ে বসে গেছেই তখন বইতে থাকি মানসিকতার প্রকাশ পেতে শুরু করে। অনেকেই হয়তো এভাবেই জীবন পার করে দেয় কিংবা জীবনের হাতেই লাগাম তুলে দিয়ে নিজের আবশ্যিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেই একদিন দেয়ালে ঝুলে যায় ফ্রেমে বাঁধা নিশ্চল চেতনাহীন চেতনা হয়ে।

কিন্তু যদি তাকে কাছে পেতে হবে কেবলই জীবনের অপার্থিব পূর্ণতাগুলোকে বুকে টেনে নেয়ার উদ্দেশ্যে তখনই আপনি ধরে নিতে পারেন আপনি তাকে ভালবাসেন বা তাকে পেতে চান কারণ তাকে আপনি  আপনার জীবনের লক্ষ্য নয়, জীবনের রুবিকস কিউবের প্রতিটি বর্গকে পরিপূর্ণভাবে মিলিয়ে নিয়ে আবারো সেটাকে এলোমেলো করে দিয়ে পূণরায় তাকে মেলানোর চেষ্টায় লেগে গিয়ে নতুন কোন উপায়ে তাকে আবারো নিজের ভেতরের শূন্যতা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে দুই হাতের আলতো ভাজে সযতনে এখানে ওখানে ঘুরাচ্ছেন আর মিলিয়ে যাচ্ছেন নিজের সকল ভারসাম্যের হিসাব। এমন যদি হয় যে আমার জীবনে তুমি নেই, এমন বোধ আমাকে কাবু করে, আমার নিশ্বাস আটকে দিতে চায় তাহলে বুঝতে হবে আমি তাকে ভালবাসি আমার জীবনের সেই শ্রেষ্ঠ অংশটার মতো করে যেই অংশের পুরোটাই তাকে দিয়ে পূরন করা যাবে বলে সমস্ত সত্তা তার বিশ্বাসের অংশে শক্তিশালী পতাকা উঁচিয়ে জানান দেয় এই মানুষটিই তোমার সত্তার বাকী অংশ, তাকে আগলে নাও, তাকে তোমার সাথে মিশিয়ে নিয়ে পরিপূর্ণ হও। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *