রবার্তো কার্লোস: মাদ্রিদের এক ব্রাজিলিয়ান হারকিউলিস

কার্লোসকে নিয়ে শুরুর আগে মাদ্রিদের গ্যালাকটিকোর অংশ হবার প্রাক-পর্বটা আগে বলে নিতে মন চাইছে বেশি। রিয়ালে আসার ঠিক আগে কার্লোস ইন্টার মিলানে খেলেছেন। ইন্টারের হয়ে অভিষেক ম্যাচে  জোরালো শটে গোল করেন বাম উইং দিয়ে, সম্ভবত এটা দেখেই কিনা তৎকালীন ইন্টার বস রয় হজসন রবার্তো কার্লোসকে উইঙ্গার বানানোর মিশন নেন আর ফলশ্রুতিতে কার্লোসের নিজের ভুমিকা ভুলে গিয়ে উইংয়ে খাবি খাওয়া শুরু করলেন অনেকটা কাকের ময়ুরের হাটা শিখতে গিয়ে নিজের হাটা ভুলে যাওয়ার দশা আর কি!! যাইহোক এতে নেরাজ্জুরিদের লাভের লাভ কিছুই হয় নি ফাঁকতালে লাভের গুড় নিয়ে নিলেন তৎকালীন মাদ্রিদ বস ফাবিও ক্যাপেলো, তার ডিফেন্সিভ খেলায় এমন একজন দরকার যিনি ডিফেন্স সামলাবেন হাতির মতো আবার লেফট উইং দিয়ে চিতার গতিতে বল পার করে দেবেন মিডফিল্ডের ওইপাশে। আবার সেই চিতার গতিতেই ফিরে আসবেন নিজের ডেরায়। আর তাই তিনি ক্লাব প্রধান লরেঞ্জো সাঞ্জকে তার চাহিদা জানাতেই সাঞ্জ ইতালি থেকে উড়িয়ে আনেন এই ডিফেন্স দৈত্যকে। আর এভাবেই আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেন ডিফেন্সের সংজ্ঞাটা নিজের মতো করে লেখা এই রক্ষণ যাদুকরের।

শুরু থেকে শুরু

এখনো কৈশোরে পা না দেয়া বালক ছেলেটি তার মা আর বাবার সাথে সারাদিন মাঠে কাজ করে সন্ধ্যের আলো একটু থাকতেই বাড়ি ফেরে, মা বাবা হাফ ছেড়ে দিয়ে ঘরের বারান্দায় সারাদিনের কাজের সঙ্গী কোদাল, নিড়ানি আর ঝাকিটা ফেলে দিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়ার আশায় বারান্দাতেই বসে পড়ে। আর ঘেমে-নেয়ে একাকার ছোট্ট রবার্তো তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে নিচের দিকে মাথা ঝুকিয়ে পা দিয়ে মাটি ঘষতে ঘষতে বলে, “বাবা, আমি একটু খেলতে যাই?” তার কথা শুনে মা-বাবা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, বাবা ধমক দিতে পারে এই ভয়ে মনে মনে কুকড়ে যাওয়া বালক দেখতে পায় তার বাবা তার দিকে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে যাও খেলতে যাও, তবে বেশি দেরি করো না, অনেক পরিশ্রম করেছো তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বিশ্রাম নিবে। বাবার মুখে এই কথা শোনামাত্রই দৌড়ে পাড়ার মাঠে চলে যায় আমাদের রক্ষণের একনিষ্ঠ নেতা। খর্বকায় এই ছেলেটিই যে একদিন তামাম দুনিয়ায় রক্ষণে মাইন বিছিয়ে দিয়ে গোলা ছুড়বে তখনোও কেউ ভাবে নি। কেউ-ই না, হয়তো তার বাবা তার ছেলের চোখে কিছু দেখলেও দেখতে পারে, তাই তো ছেলেকে আটকান নি সেদিন৷
বাবার অনুমতি পাওয়া ছোট্ট রবার্তো তাই ধুলো উড়িয়ে দৌড়ে চলে যায়  সাও পাওলো রাজ্যের গার্সা শহরের কোন এক মাঠে, যেখানে আগে থেকেই ধুলো উড়িয়ে ফুটবল খেলছিলো তার বয়সী একদল ছেলে। গায়ে শুধু একটি জীর্ণ হাফপ্যান্ট পরা, জামা নেই বা খেলার বুট নেই তার পায়ে, তবুও ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ আর প্রেমের কাছে দারিদ্র্য লজ্জা পেয়ে তাকে সফলতার পথ ছেড়ে দিয়েছে। ফুটবল খেলতে পারার আনন্দ যার চোখেমুখ থেকে দরিদ্রতার চিহ্ন মুছে দিচ্ছে সেই ছেলের পায়ের যাদু আটকায় এমন শক্তি দারিদ্রের আছে নাকি?
এভাবেই চলছিলো ফুটবলের প্রতি প্রেমে কাতর আমাদের খর্বকায় কিন্তু শক্তিশালী কামানের মতো দুটি পায়ের অধিকারী এই রক্ষণ দৈত্যের বাল্যকাল।

সাও জোয়াও-তে কার্লোস

তেমনি এক ক্লান্ত বিকেলে গার্সার মাঠে ধুলোয় ঝড় তোলা এই বালকের দিকে তাকিয়ে আছেন এক মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক, আকাশে তখন গোধূলির জ্বলজ্বলে আলো জানান দিচ্ছে খেলার পাট চুকিয়ে দেয়ার। এমন সময় ছেলেটিরও চোখ পড়ল মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ব্যক্তির উপর যিনি কি-না তাকেই দেখছিলেন। চোখাচোখি হতেই ছেলেটিকে ডাক দিলেন ভদ্রলোক। লোকটি নিজেকে সাও পাওলো রাজ্যের আঞ্চলিক ক্লাব ‘উনিয়াও সাও জোয়াও’ এর এক স্কাউট হিসেবে পরিচয় দিয়ে ছোট্ট রবার্তোকে সাও জোয়াও এর অ্যাকাডেমিতে ট্রায়াল দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। সাথে তার মাথায় হাত বুলিয়ে এটাও বললেন যে, অচিরেই তুমি একজন বড় মাপের ফুটবলারে পরিণত হবে। কিন্তু দরিদ্র এই বালকের দুর্ভাগ্য যে  ক্লাবের অ্যাকাডেমি পর্যন্ত যাওয়ার মতো বাস ভাড়া ছিল না তার কাছে। আমাদের বালক রবার্তো তো দমে যাওয়ার ছেলে নয়, তার বুকপকেটে বাস ভাড়া না থাকলেও বুক জুড়ে ছিলো ফুটবলের প্রতি অদম্য প্রেম আর এই  প্রেম ও দুর্দমনীয়  মনোবল নিয়েই একদিন হাটা দিলেন শহরের অপর প্রান্তের সাও জোয়াও ক্লাবের একাডেমিতে, হেটেই উপস্থিত। যার বুকে ফুটবলার হওয়ার আশা সেই ছোটবেলা থেকে তাকে কি আর শুধু বাস ভাড়া দমিয়ে রাখতে পারে? ছেলেটি হেঁটে পাড়ি দিল সাও পাওলো রাজ্যের অন্য মাথায়!

স্বপ্নের শুরু

একাডেমির স্কাউটের সাথে দেখা করে তাকে নিয়েই চলে গেলেন কোচের সাথে দেখা করতে। কোচ তাকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে গেলেন একাডেমির প্লে গ্রাউন্ডে, যেখানে তার কাছাকাছি বয়সের অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে খেলতেছিলো। কোচ কাছাকাছি একটা দলের কোন এক খেলোয়াড়কে ডেকে নিয়ে কিছু একটা বলার পরেই ছোট্ট রবার্তোকে কিট আপ করে খেলতে নামতে বলেন।
আর সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন নতুন এই ছেলেটির খেলা। ছেলেটির অসাধারণ দম, শক্তি, গতি, টেকনিকাল দক্ষতা আর পায়ের জোর দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন ক্লাব কোচ।
খেলার মাঝপথেই তাকে ডেকে নিয়ে ক্লাবের অফিসকক্ষে গেলেন আর তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন একটা ফর্ম আর মুখে বললেন তুমি চাইলেই এই ফর্ম পূরণ করে হয়ে যেতে পারো আমাদের ইয়ুথ অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়। এই প্রস্তাব শুনেই আবেগে অশ্রুসিক্ত রবার্তোর চোখেমুখে জ্বলে উঠলো নিজের প্রিয় ফুটবল খেলার অবারিত সুযোগের আনন্দে। ফুটবলপ্রান বালকটি কি এই সুযোগ কি কখনো হাতছাড়া করতে চাইবে? এক প্রকার টেবিল থেকে ছো মেরে ফর্ম নিয়েই  স্বাক্ষর করে দিল সে। তার এই একটা স্বাক্ষর, ফুটবলের সাথে গাটছড়া বাধতে যাওয়ায় কলমের এক অতিক্ষুদ্র খোচায় ঐতিহাসিক ও সাফল্যে ঘেরা ক্যারিয়ারের উপক্রমণিকা লেখাটা শুরু করে দিলেন আমাদের সদাহাস্যোজ্জ্বল রবার্তো, রবার্তো কার্লোস। ফুটবল মাঠে যিনি দুই পায়ের নৈবেদ্য ঢেলে দিয়েছেন গোলক দেবতার পায়ে, বিনিময়ে দু’হাত ভরে প্রসাদ নিয়েছেন তুষ্ট দেবতা চর্মগোলকনাথ এর হস্ত হতে।  ফুটবল পায়ে তার  দাগানো কামান হতে যে গোলাবর্ষণ করতেন তার জন্যই এই রক্ষণ দানবের কেতাবি নামের চেয়েও দ্য বুলেট ম্যান” নামেই বেশি চিনেছে বোদ্ধারা।

এবার আসুন রবার্তো কার্লোসের চকচকে টাকের আলোয় দেখে আসি তার ক্যারিয়ার গ্রাফের এক উল্লম্ফনীয় চিত্র। কি ক্লাব, কি জাতীয় দল, যেখানেই খেলেছেন, নিজেকে প্রমাণ করেছেন, ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজের প্রতিদিনের পারফরম্যান্সকে।

পেশাদার ফুটবলে পা রাখা

সালটা ১৯৯১, সাও জোয়াও-এ পেশাদার ফুটবলের প্রথম মৌসুমেই নজরকাড়া পারফরম্যান্স করে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ব্রাজিল জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান। আর অভিষেক বছরেই ৭ ম্যাচ খেলে বুঝিয়ে দিলেন কেন তাকে ব্রাজিল দলে ডাকা হয়েছে। সাও জোয়াও-এ দুই বছর কাটানোর পর নাম লেখালেন ব্রাজিলের পালমেইরাস ক্লাবে। আর সেখান থেকে তার ইতিহাসের সিড়ি ভেঙে অমরত্বের যাত্রা শুরু হয়ে যায়।

পালমেইরাসে ২ মৌসুম কাটিয়ে জিতলেন ২টি ব্রাজিলিয়ান লিগ সহ ৫টি শিরোপা। তার পারফরম্যান্স ইউরোপের অনেক ক্লাবের নজর তার দিকে আনতে বাধ্যই করলো এক প্রকার। বেশ কয়েকটি ক্লাব থেকে প্রস্তাব আসার পরেও পালমেইরাস তখনকার ইংলিশ জায়ান্ট মিডলসবোরোতে কার্লোসকে বিক্রি করবে মোটামুটি এমনটা ঠিক থাকলেও হুট করেই ইন্টার মিলান দলবদলের পিচে এসে কার্লোসকে অনেকটা ছোঁ মেরেই নিয়ে গেলো বলা যায়। অনেকটা কার্লোসের নিজের আগ্রহ ও পালমেইরাসের লাভের হিসাব মিলে যাওয়াতেই নেরাজ্জুরিদের আস্তানায় চলে আসা হলো দ্য বুলেটম্যানের৷

সিরি-আতে অভিষেক ম্যাচেই ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে এক অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন গোল! ওই মৌসুমে নিজের পারফরম্যান্স ভালো হলেও দলের হয়ে কোন ট্রফিই জেতা হয় নি তার। হবেই বা কি করে ইন্টার মিলান বস রয় হজসন যুদ্ধে যখন ঢালকে তলোয়ার আর তলোয়ারকে ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ করবেন তখন ডিফেন্সযোদ্ধাকে লেফট উইং থেকে আবারো লেফট ব্যাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আরেক ইতালিয়ান ক্যাপেলাই হাত লাগিয়ে তাকে ইতালি থেকে স্পেনে নিয়ে এলেন। ক্যাপেলো পেয়ে গেলেন তার মনের মতো চিতার গতি আর দৃঢ় হাতির মতো রক্ষণ আগলে রাখার গুণসম্পন্ন উইং ব্যাক, যিনি রক্ষণ থেকে নিপুণ কর্মকারের মতো বলকে লেফট উইং ধরে নিদেনপক্ষে মিডফিল্ড পার করে আক্রমণে শান দিয়ে তার ধার বাড়িয়ে দেবেন আবার একই সাথে দক্ষ রাখাল বালকের মতো তেড়ে আসা সকল এড়ে কিংবা ষাড়ের শিং বাকিয়ে আসা আক্রমণ ফিরিয়ে নিজের গোয়াল অক্ষুণ্ণ রাখবেন আবার নিজ গোয়ালের কঠোর পরিশ্রমী হালের বলদটা কিংবা দুধ দেয়া ধবলীর মুখে সবুজ ঘাস তুলে দেবেন পরম যত্নে, যাতে করে ভোরের হালচাষ আর সকালের দুধ দোহনে সেরা ফলটা পাওয়া যায়।  এই ছিলেন আমাদের রবার্তো কার্লোস, দ্য বুলেট ম্যান!

রবার্তো কার্লোস

সিরি-আ থেকে লালীগায়

১৯৯৬ সালে মাদ্রিদে যখন যোগ দিলেন তখনো গ্যালাক্টিকো প্রজন্মের সূচনা হয়নি। ১৯৯৭ সালে লা লিগা ও সুপারকোপা জিতে ফর্মের তুঙ্গে রয়েছেন তিনি। একই সাথে জাতীয় দলের হয়ে কোপা আমেরিকা এবং কনফেডারেশনস কাপ জয়, সেই সাথে ফ্রান্সের বিপক্ষে একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ফুটবল ইতিহাসের সেরা ব্যানানা শট তাকে নিয়ে গেল খ্যাতির চূড়ান্ত সীমানায়।

১৯৯৭ সালে হলেন ফিফার ২য় সেরা খেলোয়াড়,  একই ধারায় পরের বছরও নিজের পারফরম্যান্স অক্ষুণ্ণ রেখে হাতে নিলেন ইউরোপের সর্বোচ্চ শিরোপা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন লীগ, পাশাপাশি কব্জায় নিলেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও। মাঝে ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপের ফাইনালে স্বাগতিকদের কাছে পরাজয়ের দুঃস্বপ্ন সেবার বিশ্বকাপ হাতে নেবার স্বাদ থেকে বঞ্চিত না করলে হয়তো কিংবদন্তি হওয়াটা আরো আগেই হয়ে যেতো এই টেকো মাস্টার শুটারের৷ সেই কাটা ঘায়ে প্রলেপ মাখিয়ে ১৯৯৯ সালে আবারো কোপা আমেরিকা ট্রফি উচিয়ে ধরে নিজেকে জাত বিজয়ীদের দলভুক্ত করে নিলেন, হয়ে গেলে হলুদ ও সাদা জার্সির রক্ষণ সেনাপতি।

একুশ শতকের শুরুতেই আবারো দুর্দান্ত ফর্মে রক্ষণের একনিষ্ঠ নেতা হিসেবে সাদা দুর্গ আগলে রেখে জিতে নিলেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ, পাশাপাশি পাওলো মালদিনির পাশাপাশি নিজেকে অন্যতম সেরা লেফট ব্যাক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আর কোন তর্কের অবকাশ রাখেন নি কোন ক্রীড়ামোদীর মনে।

রক্ষণের পাশাপাশি আক্রমণেও যে কম যান না তার প্রমান ক্যারিয়ারে ১১৭ গোল। তার সময়ে ফুটবলের সবচেয়ে আক্রমনাত্মক খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেতে এরচেয়ে বেশী গোলের দরকার আছে?? আর গতি? তুলনামূলক খাটো উচ্চতার এই খেলোয়াড়ের পায়ের গতি কেমন ছিলো তা তো বামপাশ দিয়ে তার আক্রমণে শান দেয়ার ধরণ দেখেই বলা যেতো, আর তার এরাবিয়ান ঘোড়ার মতো পেশীবহুল পায়ের কিক খেয়ে বাতাসে ফুটবলের গতির সামনে যে পড়েছে কেবল সে-ই জানে তার লাথি খেয়ে বলের বড় কাটরার গোলা হয়ে উঠা পরাক্রমের কেমন প্রতাপ ছিলো। ভাবা যায়, তার একেকটা শট চর্মগোলকে গড়ে ১৬৯ কিমি গতি এনে দিতে সক্ষম ছিলো!!

বিশ্বকাপে কার্লোস

কার্লোসের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্বপ্নীল বছর ছিলো ২০০২ সাল। একই সাথে হলুদ জার্সির হয়ে ১৯৯৮ সালে দুঃস্বপ্ন মুছে দিয়ে জিতে নিলেন ফুটবল বিশ্বকাপ, তাও তারকাঠাসা ইউরোপের পরাশক্তি, যান্ত্রিক ফুটবলের ধ্বজাধারী, ইনফর্ম জার্মানিকে ২-০ গোলে এক প্রকার নক আউট করে। সাথে যদি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগটাও মুঠোয় পুরে নেয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা, তাই না? ঠিক তাই, সেটাই হলো কার্লোসের বর্ণিল এই বছরে, জিতে নিলেন সে বছরের আরেক জার্মান পরাশক্তি বেয়ার লেভারকুসেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইউরোপ সেরার ট্রফিটাও। একই মুকুটে পালক হিসেবে গুজে নিলেন উয়েফা সুপার কাপ আর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও। জায়গা করে নিলেন উয়েফা টিম অফ দ্য ইয়ারে। পেয়ে গেলেন ডিফেন্ডার অফ দ্য ইয়ারের খেতাবও। একজন ফুটবলারের জীবনে এমন একটা ক্যালেন্ডার ইয়ার থাকলেই কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া যায় আর আমাদের বুলেটম্যান তো সত্যিকারের কিংবদন্তি হয়ে কিংবদন্তিদের ইতিহাস লিখে দিলেন নিজের হাতে।



২০০৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার আগে মাঝের বছরগুলোতে রিয়াল তার প্রথম গ্যালাকটিকো গড়ে তুললেও মাঠের খেলায় সাদার আভিজাত্য ফুটে উঠে নি নিকট অতীতের মতোও। দল হিসবে ভালো খেললেও সেটা লস ব্লাংকোস স্ট্যান্ডার্ডস ধরে রাখতে পারে নি। এতো এতো সুপারস্টার নিয়েও মাদ্রিদ বড় কোন ট্রফি জিতে নি। বলা যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার সোনালী প্রজন্মের উত্থানে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো মাদ্রিদের আভিজাত্য,  ফুটবলের তাবৎ সব সন্যাসীদের হাট বসিয়ে গাজন নষ্ট করা হলো সার, মাঠের খেলায় সাদার ডিএনএ তার প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে নি বলা যায়। তবুও যা কিছু অর্জন ছিলো সেটাও কম নয় অন্য যেকোনো দলের জন্য কিন্তু মাদ্রিদ বলেই মাঝের এই ৫ বছরে দুই বার লীগ জয় নিতান্তই কম কিছু নয়। কিন্তু দলটা যে রিয়াল মাদ্রিদ, শুধু লীগ জয়ে ঠিক তৃপ্তির ঢেঁকুরটা আসে না।

যদিও ততদিনে লা লিগায় বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে ডি স্টেফানোর সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন তিনি।  রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সেরা বিদেশি খেলোয়াড়দের দলেও জায়গা করে নিয়েছেন এই রক্ষণ সেনাপতি। ৩টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ও ৪টি লিগ শিরোপাসহ মোট ১৩টি ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সৌভাগ্য অর্জন করেন সাদা জার্সি গায়ে।

মাদ্রিদে শেষের শুরু

কিন্তু ২০০৬ এ গ্যালাকটিকোর ধারণা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার ফলস্বরূপ ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের পদত্যাগের ঘোষণা আসার পর এই তারার হাট ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যেতে থাকে, কেউ অবসরে যান, কেউ চলে যান অন্য কোন দলে। তেমনি আমাদের বুলেটম্যানও তার বিদায়ের রাগিনী বাজিয়ে সবাইকে আবেগে ভাসিয়ে চলে যান তুরস্কের দল ফেনেরবাখে। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে নাড়ীর টানে কিংবা পড়ন্ত বেলার অস্তমিত সূর্যের মতো নিজভূমে ফিরে যান। করিন্থিয়ানসের হয়ে এক মৌসুম কাটিয়ে ফিরে আসেন ইউরোপের ক্লাব আনঝি মাখাচকালায়। এই ক্লাবে খেলেই শেষ করেন ২২ বছরের সুদীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারের। অবশ্য এই ক্লাবে খেলোয়াড় থাকা অবস্থাতেই কিছুদিন কেয়ারটেকার কোচের দায়িত্ব পালন করে কোচিং ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন কিছু করার ইঙ্গিত দিলেও তা সেই মৌসুমেই শেষ হয়ে যায়। অবশ্য ইঙ্গিত দিয়ে রাখে ভবিষ্যৎ হয়তো তাকে ডাগ আউটে নিয়ে আসবে।  যার ফলস্বরূপ ২০১৫ তে অবসর ভেঙ্গে ৪২ বছর বয়সে ইন্ডিয়ান সুপার লীগের দল দিল্লী ডায়নামোসে হেড কোচ ও খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দেন, অনেকটা ইন্ডিয়ান সুপার লীগের ব্রান্ডিং ফেস হিসেবেই। দুটি ম্যাচ খেলেই বুঝে গেলেন খেলোয়াড় হিসেবে আর নয়, বাকি সিজন কোচ হিসেবে ডাগ আউটেই ছিলেন। পরের মৌসুমেও কোচের দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও সেটা আর হয়ে উঠে নি। এখন পর্যন্ত কোচিং নিয়ে সিরিয়াস না হওয়া এই কিংবদন্তি।

রিয়াল মাদ্রিদ ও রবার্তো কার্লোসের কেমিস্ট্রি

শেষ করছি রিয়াল মাদ্রিদ ও তার নিজেকে নিয়ে আমাদের বুলেটম্যানের দুটো চমৎকার উক্তি দিয়ে, 

“এই ক্লাবের মানসিকতা ও বিশালতা অন্যসব ক্লাব থেকে তাকে আলাদা করে” নিজের ক্যারিয়ারের উপক্রমণিকা ও যবনিকাপাতের সূচনা যে ক্লাবে সেই ক্লাব নিয়ে ছোট্ট এই মূল্যায়ন ক্লাবের প্রতি তার নিবেদনকে আরো উচুতে নিয়ে যায়।

এবং ক্লাব ছাড়ার আগে তার নিজের সম্পর্কে বলা, “এই ক্লাবে আমার আরো দুই মৌসুমের চুক্তি বিদ্যমান রয়েছে, তবুও এই দলে কারো বিকল্প হওয়াটা আমার জন্য পীড়াদায়ক হবে”।
নিজের প্রতি কতটা সম্মান আর ক্লাবের প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে দুই মৌসুমের চুক্তি হাতে থাকার পরেও ক্লাব ও নিজের অবস্থান উচুতে স্থাপন করে গেছেন আর রেখে গেছেন চ্যাম্পিয়নের স্বাক্ষর।

কার্লোসকে নিয়ে শুরুর আগে মাদ্রিদের গ্যালাকটিকোর অংশ হবার প্রাক-পর্বটা আগে বলে নিতে মন চাইছে বেশি। রিয়ালে আসার ঠিক আগে কার্লোস ইন্টার মিলানে খেলেছেন। ইন্টারের হয়ে অভিষেক ম্যাচে  জোরালো শটে গোল করেন বাম উইং দিয়ে, সম্ভবত এটা দেখেই কিনা তৎকালীন ইন্টার বস রয় হজসন রবার্তো কার্লোসকে উইঙ্গার বানানোর মিশন নেন আর ফলশ্রুতিতে কার্লোসের নিজের ভুমিকা ভুলে গিয়ে উইংয়ে খাবি খাওয়া শুরু করলেন অনেকটা কাকের ময়ুরের হাটা শিখতে গিয়ে নিজের হাটক ভুলে যাওয়ার দশা আর কি!! যাইহোক এতে নেরাজ্জুরিদের লাভের লাভ কিছুই হয় নি ফাঁকতালে লাভের গুড় নিয়ে নিলেন তৎকালীন মাদ্রিদ বস ফাবিও ক্যাপেলো, তার ডিফেন্সিভ খেলায় এমন একজন দরকার যিনি ডিফেন্স সামলাবেন হাতির মতো আবার লেফট উইং দিয়ে চিতার গতিতে বল পার করে দেবেন মিডফিল্ডের ওইপাশে। আবার সেই চিতার গতিতেই ফিরে আসবেন নিজের ডেরায়। আর তাই তিনি ক্লাব প্রধান লরেঞ্জো সাঞ্জকে তার চাহিদা জানাতেই সাঞ্জ ইতালি থেকে উড়িয়ে আনেন এই ডিফেন্স দৈত্যকে। আর এভাবেই আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেন ডিফেন্সের সংজ্ঞাটা নিজের মতো করে লেখা এই রক্ষণ যাদুকরের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *