hijol-tomal

হিজল, তমাল আর করচের বাঁকে

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা যেন প্রতিনিয়ত প্রকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত করার মিশন নিয়ে নেমেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য। এখানে রয়েছে জাফলং পাথর কোয়ারী ও সংগ্রামপুঞ্জির মায়া ঝর্ণা, তেমনি আছে বিছানাকান্দির পাথুরে স্বচ্ছ জলের স্রোতে ভাসা পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্য। তেমনি আছে দেশের সবচেয়ে বড় মিঠাপানির জলাবন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনন্য এক নাম এই রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। ঠিক তেমনি একটি জলাবনের সন্ধান মিলেছে এই গোয়াইনঘাট উপজেলাতে। বলদী হাওর নামে পরিচিত এই জলাবন পর্যটন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে বলেই বিশ্বাস করা হচ্ছে।

অবস্থান

সিলেটের  গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল ইউনিয়নের লাকি গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত  বলদী হাওর ও ফুলতৈছগাম গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত পুকচাওইর  হাওর সম্প্রতি ভ্রমণ পিপাসু দেশী এবং বিদেশী পর্যটকদের মন আকৃষ্ট  করছে। এটি হতে পারে রূপসী বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা প্রকৃতি কন্যা সিলেটের  পর্যটন  উপজেলা হিসেবে খ্যাত গেয়াইনঘাট উপজেলার  সম্ভাবনার এক নতুন পর্যটন কেন্দ্র। সুপ্রাচীন আমলের বড় বড় হিজল, জারুল,করচ গাছগুলো চৈত্রের বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে যেন নতুন করে সবুজ রঙের বাহারি শাড়ী পড়েছে। গাছে গাছে গজিয়েছে নতুন পাতা। সবুজ পাতার মায়াবী আঁচলে মুগ্ধ করছে লাখো পর্যটকদের। যান্ত্রিক জীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যে একটু শীতল বাতাস ও বৃক্ষ শাখার ছায়া পাবার জন্য শহর, নগর, গ্রামাঞ্চল তথা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে ভ্রমণ পিপাসু লোকজন, যান্ত্রিক জীবনের শত ক্লান্তি শেষে একটুখানি জিরিয়ে নেবার আশায়।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে জানা যায়,  প্রায় ৫ হাজার একর জমি নিয়ে এই বিশাল জলাশয় ও বনাঞ্চলটি অবস্থিত। এই বনাঞ্চলের পুর্ব পার্শ্বে রয়েছে তোয়াকুল ইউনিয়নের লাকী, কামারগ্রাম ও ফুলতৈছগাম গ্রাম তিনটি। এটি মুলত খাটিয়া বিলের দক্ষিণ পুর্ব, পুকচাওইর ও পানিচাবরা বিলের পুর্ব পাশ্বে অবস্থিত। স্থানীয় লোকদের কাছে এটি বলদী হাওর নামে পরিচিত। 

হিজল বন

জারুল, হিজল ও করচের দেশে

এখানে রয়েছে ঘন ঘন  জারুল গাছের এক বিরাট সমারোহ এবং হরেক রকমের গাছ গাছালি। রয়েছে হিজল গাছের সারি। শক্ত মুল ও উচ্চ শাখা প্রশাখা সমৃদ্ধ হিজল গাছ বর্ষার মৌসুমে পানিতে জন্মে।

শত শত বছর যাবত গাছ গুলি প্রাচীন বন বাদাড় এবং জঙ্গলের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। নল, খাগড়া, ইকড়, প্রাকৃতিক লতা পাতায় ঘেরা এই বনে রয়েছে সারি সারি মুর্তার বাগান। প্রতি বছর বন বিভাগের মাধ্যমে এই বনের মুর্তা নিলামে বিক্রি হয় এবং লোকজন মুর্তা কেটে নিয়ে যায়। এই বনের মুর্তা বেত দিয়ে তৈরি হয় আদি সিলেটের ঐতিহ্যঘেরা শীতল পাটি। যা ইতোমধ্যে দেশ ও বিদেশে সিলেটের সুনাম অর্জন করেছে। প্রকৃতির নিপুণ অরণ্যঘেরা এই এই হাওরে দল বেধে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত পাখির কিচিরমিচির এবং অসংখ্য  হনুমান ও বানরের  অভয়ারণ্য হয়ে আছে এই বলদী হাওরের জঙ্গল। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা লক্ষনীয়। নিম্নভুমি হওয়ায় জমির মাঝে মাঝে রয়েছে জলাশয় ও ছোট ছোট বিল। এসব বিলে প্রচুর প্রাকৃতিক মাছ পাওয়া যায়, যা চাষ করা বা পুকুরের মাছের চেয়েও সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।  বিলের মাছ দিয়ে পাশ্ববর্তী গ্রামের মানুষ তাদের মৎস্য চাহিদা পুরণ করে। পড়ন্ত বিকেল কিংবা গোধুলী লগনে এই বনাঞ্চলে প্রবেশ করলে মনে হবে প্রকৃতির এক অন্যরকম  নির্জন জায়গা। যেখানে শোনা যাবে শুধু পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দ। বিভিন্ন প্রজাতীর পাখির আবাসস্থল এই গহীন বনে হরেক রকমের পাখিদের মধ্যে ঘুঘু, ডাহুক, পানকৌড়ি, শালিক,ময়না, টিয়া, পাতিহাস, ঈগল, বক সহ শত শত প্রজাতির পাখি এই বনে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও শীতকালে অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এই বন। এলাকার মানুষেরাও এই বনের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় খুবই আন্তরিক। 

হাওরটিতে যেমনি রয়েছে অনেক গুলো ছোট ছোট বিল, তেমনি রয়েছে দিগন্ত জোড়া  বিশাল মাঠ এবং ছায়া ঘেরা মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল। বনের পাশে জমিতে ফলে কৃষকের সোনালী ধান। বিশাল পতিত জমিতে রয়েছে  অত্র এলাকার  গোচারণভূমি। 

গরু, মহিষ, ছাগল এই জঙ্গলে চরাট করতে আসে। গৃহ পালিত পশুর জন্য এই জঙ্গলে প্রচুর প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া নরম ঘাস ও লতাপাতা। প্রকৃতির এক সমভাবাপন্ন আবহাওয়ার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ যেন এই হিজল, তমালের ছায়াঘেরা এই বন। 

বর্ষার উচ্ছল কিশোরী কন্যা

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব ঋতুতেই এই বন আপনাকে কাছে টেনে নেবে পরম মমতায়। মিষ্টি হাওয়ার স্নিগ্ধ ও কোমল পরশ বুলিয়ে দিয়ে ট্যুরিস্টদের মনে  অসম্ভব এক  ভালো লাগার এক অনুভূতি জাগিয়ে দেবে এই সবুজবীথির এই বন।

সারাবছরই এই বনে ঘুরে যাওয়া যায়। তবে শুকনো মৌসুমের চেয়ে বর্ষার মৌসুমে এই বনের সৌন্দর্য যেন আরো বেড়ে যায়। বর্ষার বৃষ্টির ছোয়ায় এর সবুজ যেন শ্যামলিমায় ছেয়ে দেয় পুরো বনাঞ্চলটিতে। নরম ঘাসের সবুজ গালিচার উপর সুবিশাল হিজল, তমাল, করচ, জারুল গাছের বিন্যাসের মাঝেই যে সবুজ চাদরে মোড়ানো একটি প্রাকৃতিক বিছানার মতো এক বন এটি। এখানে এসে নিজেকে মেলে ধরুন, তুলে ধরুন, দেখবেন সমস্ত চাপ, অস্বস্তি, মানসিক অস্থিরতা ভুলে এক নতুন নিজেকে খুজে পাবেন। বর্ষায় যেন এই জঙ্গল তার যৌবন ফিরে পায়৷ আর তাই তো তার যৌবনের লাস্যময়ী রূপদর্শনে পর্যটকেরা ভীর জমায় সুন্দরী এই বনের বুকে।  অনেকের মতে এই বনটি দেশের সবচেয়ে বড় মিঠাপানির জলাবন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট এর চেয়েও সুন্দর, যা একই উপজেলায় অবস্থিত। বর্ষার দিনে স্বচ্ছ সুন্দর জলরাশির মধ্যে ভাসমান বৃক্ষ গুলো যেন এক অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আসর জমিয়ে বসে থাকে পর্যটকদের উপহার দেবার জন্য।  তাছাড়া বর্ষার ভরা পানিতে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে ঘুরানো ও সহজ। 

বর্ষায় অপরূপ হিজল করচ বন

যোগাযোগ

যাতায়াতের জন্য রয়েছে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা। সিলেট শহর থেকে বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে সালুটিকর বাজার হয়ে গোয়াইনঘাট রোডে স্থানীয় তোয়াকুল বাজার যাওয়ার একটু আগে হাতের বামে ফুলতৈলছগাম গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে সোজা পশ্চিমে যেতে যেতে দেখা মিলবে অনিন্দ্য সুন্দর এই হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য্যের। 

অথবা সালুটিকর বাজার থেকে সিলেট-ভোলাগঞ্জ রোড তিন কিলোমিটার এগিয়ে হাতের ডানে খাগাইল বাজার রাস্তা হয়ে স্থানীয় হায়দরী বাজার থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকালেই দেখা মিলবে  এই বিস্তীর্ণ হাওরের সবুজবীথি। বর্ষার মৌসুমে এই বনে যাতায়াতের সুবিধা আরো বেশি, এবং এর সৌন্দর্য যেন তখন ডানা মেলে নিজেকে প্রকাশ করে। স্থানীয় বালিদ্বার এর ব্রিজ থেকে ছোট নৌকা নিয়ে এই বনে ইচ্ছে মতো ঘুরে আসা যাবে।

যাতায়াত ভাড়া

সিলেট আম্বরখানা থেকে সিএনজি অটোরিকশায় সালুটিকর বাজার পর্যন্ত ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে নেমে আরেকটা সিএনজি অটোরিকশা হয়ে ৪০/৫০ টাকা ভাড়ায় বলদী হাওরে যাওয়া যাবে অথবা আম্বরখানা থেকে সোজা ফুলতৈলছগ্রাম পর্যন্ত জনপ্রতি ৭০/৮০ টাকা ভাড়া দিয়ে সিএনজি যোগে যাওয়া যায়। এছাড়া আম্বরখানা থেকে একটু সামনে মজুমদারী থেকে বাসযোগে একই রাস্তায় যাওয়া যাবে। আর বর্ষাকালে সালুটিকর বা বালিদ্বার ব্রিজ থেকে ছোট নোকায় ৪০০/৫০০ টাকায় ৫/৬ জনের দল হয়ে পুরো বন ঘুরে উপভোগ করা যাবে এই সবুজ শ্যামলিমার উল্লাস দেখে আসা যাবে। 

তাহলে আর দেরি কেন? আসছে বর্ষায় ইট পাথরে ঘেরা শহরের ব্যস্ততম জীবন থেকে বেরিয়ে একটু প্রশান্তির নিশ্বাস নেয়ার জন্য শীতল হাওয়া, মুক্ত অক্সিজেন, সবুজ গাছ-গাছালির হাতছানি, প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যকে উপভোগ করার সুযোগ নেয়াই যায়। আর ফুলতৈছগ্রামের হিজল বনের মায়াবী আঁচলের মুগদ্ধতায়, সুবজ পাতার স্পর্শ নিতে বার বার ছুটে যেতে ইচ্ছে করবেই।

কবির ভাষায়:-

” বহুদিন ধরে, 

বহু ক্রোশ দূরে 

বহু ব্যয় করি,

 বহু দেশ ঘুরে

দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,

 দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু। 

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, 

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শীষের উপরে, 

একটি শিশির বিন্দু.”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *