সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান নামটির সাথে জড়িয়ে আছে বিশাল এক খন্ড সবুজের চাদরে ঢাকা শান্তির নাম। জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্রের অপুর্ব সমাহার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। যুগে যুগে ভ্রমণ পিপাসুদের পরিতৃপ্তি দিয়ে এসেছে একের পর এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর এসব নৈসর্গিক এসব স্থানগুলো। চোখ জুড়ানো মন ভুলানো এ সাতছড়ি নিয়ে আমাদের আজকের ভ্রমণ কাহিনি।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি প্রাকৃতিক উদ্যান। এটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে সাতছড়ি অবস্থিত। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ /সংশোধন আইনের বলে ২৪৩ হেক্টর বা ৬০০ একর এলাকা জুড়ে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ জাতীয় উদ্যান। সাতটি পাহাড়ি ছড়া বা সাত ছড়া বিশিষ্ট এই সাতছড়ির আগের নাম ছিলো “রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট ” মুলত সাতটি ছড়া বিশিষ্ট হওয়ায় এ জায়গার নামকরণ করা হয়েছে সাতছড়ি।
এই ক্রান্তীয় ও মিশ্র চিরহরিৎ পাহাড়ি বনভূমি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইন্দো-অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত।
এ উদ্যানটি তে কয়েকটি চা বাগান, গ্রাম,শহর,এবং চাষাবাদকৃত জমি দ্বারা নিবিড়ভাবে বেষ্টিত । উদ্যানের পশ্চিম দিকে সাতছড়ি চা বাগান এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা বাগান সুরমা চা বাগান, তেলিয়াপাড়ায় চা বাগান যেন এ উদ্যানের সৌন্দর্য কে আরও বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। উদ্যানের অভ্যন্তরে টিপরা পাড়ায় একটি পাহাড়ি উপজাতির ২৪ টি পরিবার বাস করে।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে প্রায় ২০০ টির ও বেশি গাছপালা। এর মধ্যে সগাল, সেগুন, আগর, চাপালিশ, গর্জন, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধা জারুল, আওয়াল, মালেকাস, ইউক্যালিপটাস, লটকন, আমড়া, কাঁকরা, হারগোজা, আকাশমনি, বাঁশ,বেত ইত্যাদি। জীব বৈচিত্রের দিক দিয়ে ও এ উদ্যান অনেকটা সমৃদ্ধশালী। ১৯৭ প্রজাতির জীব ও জন্তু নিয়ে সাতছড়ি তার বিশাল সম্রাজ্য নিয়ে রাজত্ব করছে।
২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর এবং আরো আছে ১৫০-২০০ প্রজাতির পাখি।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের অভয়াশ্রম। এ ছাড়া ও বিপন্ন প্রজাতির পাখি শকুনের অভয়ারণ্য হিসাবে এ বন অন্যতম।
গাছের ডালে থেকে ডালে লাফিয়ে বেড়ায় লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমা পড়া হনুমান। বুনো গাছের ফল এদের অন্যতম খাবার। বর্তমানে উল্লুক প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির প্রানী। যদিও হনুমানসহ বানরের সংখ্যা ও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ উদ্যানে আরও দেখা মিলে শিয়াল, কুলু বানর,মেছো বাঘ ইত্যাদি। শ্যামা, ময়না, বসন্ত বাউরি, ফোটা কন্ঠী, সাতবালাইসহ নাম নাজানা অনেক পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত এ উদ্যানে এলে হারিয়ে যাবে মন।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি ট্রপিকাল রেইন ফরেষ্ট বা মিশ্র চির সবুজএবং পাতা ঝরা বন। ইকো ট্যুর গাইডের সহায়তায় জীব বৈচিত্রে ভরপুর এই উদ্যানে হাইকিং করলে অপুর্ব এ বনশ্রী হৃদয়ে দাগ কাটবেই। ছোট বড় গাছের ফাঁকে সূর্য তার কিরণ ছড়িয়ে দেয়। ষড় ঋতুর এই বাংলাদেশের একেক ঋতুতে একেক রূপ। যেকোন ঋতুতে ভ্রমণ উপযোগী এই উদ্যানে আপনাকে কখনোই নিরাশ করবেনা। প্রতি বছর হাজারো পর্যটক এখানে এসে নিজের প্রশান্তি খুজেন।
এই উদ্যানের রূপ ও সৌন্দর্য যা নিজের চোখে না দেখে উপভোগ করা যায়না।
সাতছড়িতে রয়েছে পানিহীন সাতটি ছড়া, যা বর্ষাকালেও শুকিয়ে থাকে, তবে শুকিয়ে থাকলেও অবাক করা ব্যপার যে এই ছড়া গুলোতে প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে পানি বিহীন দুধের মতো সাদা বালু। এ দুধ রঙ বালুর উপরে হাটলে অন্যরকম এক অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে মন। লাল গালিচার বদলে আপনাকে স্বাগত জানাবে সাদা বালুর গালিচা। পায়ে হাটার পথে দুইপাশে রয়েছে নানা জাতের গুল্ম, লতাপাতা ও নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি।
বন বিভাগের পাশাপাশি এ উদ্যানের দায়িত্বে রয়েছে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প। নিসর্গের তত্ত্বাবধানে বন সংরক্ষণ ছাড়াও বনে ইকো ট্যুর পরিচালিত হয়। এ ছাড়াও এ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্যাদি বিক্রয় করা হয়ে থাকে।
নিসর্গ প্রকল্প এর আওতায় পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধার জন্য এ উদ্যানে ৩ টি ট্রেইল তৈরি করা হয়েছে।
🔴 আধা ঘণ্টার ট্রেইল :
১ কিমি এর এ ট্রেইলে যাত্রা করলে বনের মধ্যে অবস্থিত একমাত্র আদিবাসী গ্রাম টিপরা পাড়া গ্রামে যেতে পারবেন।
🔴 ১ ঘন্টার ট্রেইল:
বৈচিত্রপূর্ণ প্রাণী ও উদ্ভিদের সাথে পরিচিত হতে চাইলে এ ট্রেইলের কোন বিকল্প নেই। তবে এক ঘন্টার ট্রেইল কিছুটা ভীতি কাজ করলেও ভাল্লুকের অনুপস্থিতি, উল্লুকের সন্ধান করা, পথ হারিয়ে ফেলা এবং পথ খুঁজে পাওয়ার পর অনুভূতি। সবশেষে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।
🔴 ৩ ঘন্টার ট্রেইল:
প্রায় ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এ ট্রেইল পাখি প্রেমীদের জন্য আদর্শ। এ ট্রেইলে রয়েছে আগরের বন। বনের মধ্যে ট্রেকিং করতে হলে ট্রেইল অনুযায়ী ২০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে গাইড নিয়েই করা ভালো ও নিরাপদ।
এ উদ্যানের অন্যতম আকর্ষণ হলো ট্রি এডভেঞ্চার এক্টিভিটি বা ট্রি এক্টিভিটি। ভ্রমণ পিপাসুদের অন্যরকম থ্রিলার দিতে এ এডভেঞ্চার টি ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। এ উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য অন্যতম ব্যবস্থা হলো ওয়াচ-টাওয়ার। প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এ টাওয়ার থেকে এ বনের পুরোটা ই দেখা যায়।
সাতছড়ির উদ্যানে যারা আসার জন্য মনস্থির করে নিয়েছেন, তাদের জন্য রইলো এখানে আসার বিস্তারিত তথ্য।
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে হবিগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকে সাতছড়ি যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সায়দাবাদ থেকে অগ্রদূত পরিবহন, দিগন্ত পরিবহন ও বিসমিল্লাহ পরিবহন সরাসরি হবিগঞ্জ যায়।
রেল পথে হবিগঞ্জ আসতে হলে নামতে হবে সায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে। এখান থেকে হবিগঞ্জ এর দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। কমলাপুর স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন ৬.৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তনগর পারাবত এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ১০টায় ছেড়ে যায় উপবন এক্সপ্রেস।
চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮.১৫ মিনিটে ছেড়ে যায় পাহারিকা এক্সপ্রেস। শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯ টায় পাবেন উদয়ন এক্সপ্রেস।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এ থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। তবে বন বিভাগের পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষ ক্যাম্প করে দলবদ্ধভাবে থাকতে পারেন। এ ছাড়া ও রেমা কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়াশ্রমের প্রবেশ পথের পাশে “নিসর্গ তরফ হিল কটেজ” এ থাকতে পারেন। এছাড়াও হবিগঞ্জ শহরে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন পাঁচ তারকা হোটেল সহ বিভিন্ন মানের হোটেল ও কটেজ আছে।
যে যেভাবেই আসুন না কেনো এ উদ্যানে ভ্রমণের জন্য মেনে চলতে হবে কিছু সতর্কতা।
> সাতছড়ি উদ্যানে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, তাই প্রবেশের আগেই আপনার অবস্থান সম্পর্কে আপনার প্রিয়জন কে জানিয়ে রাখুন।
> গাইড ছাড়া বনের ভিতরে প্রবেশ থেকে বিরত থাকুন।
> বন্য প্রাণীদের বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন।
> যত্রতত্র ময়লা ফেলবেন না।
> এক জন দুইজন না করে গ্রুপ হয়ে ঘুরতে আসুন। এতে আপনার খরচ ও কম পড়বে এবং নিরাপত্তার দিক ও ঠিক থাকবে।
>বর্ষাকালে ভ্রমণের ক্ষেত্রে জোকের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে লবণ ও সরিষার তেল সাথে রাখুন।
>সন্ধ্যার আগেই বন ত্যাগ করুন।
জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে গাইডের সহযোগিতায় ঘুরে আসুন বাংলাদেশের অন্যতম ট্রপিকাল রেইন ফরেষ্ট সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। গহীন ঘন বন আপানার ক্লান্তি যেমন দূর করবে তেমনি আনন্দ ও দিবে। প্রকৃতি তার নয়নাভিরাম রূপ নিয়ে আমাদের আনন্দ দেয় মনকে প্রশান্তি দেয়, তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থে এই প্রকৃতির যত্ন নেবো।
দেশকে জানবো, দেশ কে ভালোবাসবো।