Dr. Fazle Rabbi

শহীদ অধ্যাপক ডাঃ ফজলে রাব্বি

ফজলে রাব্বী ১৯৩২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার হেমায়েতপুর থানার ছাতিয়ানী গ্রামের আফসার উদ্দিন আহমেদ এবং সুফিয়া খাতুন দম্পতির ঘরে জন্মলাভ করেন। পাবনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে মেধা তালিকায় বিশিষ্ট স্থান দখল করে মাধ্যমিক পাশ করেন এবং ভি.পি.আই ও জেলা ভিত্তিক বৃত্তি লাভ করেন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে একই বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫৫ সালে এমবিবিএস চুড়ান্ত পরীক্ষায় অ্যানাটমি ও ফার্মাকোলজিতে সম্মানসহ শীর্ষস্থান অধিকার করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক লাভ করেন।  পরবর্তীতে এক বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করেন এবং ১৯৬০ সাল্ব যুক্তরাজ্যের এডিনবরা থেকে এমআরসিপি ডিগ্রী লাভ করেন। দেশে ফিরে ১৯৬৩ সাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৫৫ সনে এমবিবিএস পাশ করে ১৯৫৬ সন পর্যন্ত- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি এমবিবিএস চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। ১৯৬০ সনে তিনি ইউকের এডিনবরা থেকে এমআরসিপি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৬৩ সনে দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সনে তিনি মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। বিশিষ্ট এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থেকে ৫২-র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ডা. ফজলে রাব্বী

যিনি ছোট্ট জীবনে নিজের মেধা, মানবিকতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গিয়েছন। এই সেই ডাক্তার ফজলে রাব্বি, তাঁকে যদি টাকার মূল‍্যে মূল‍্যায়ন করার কথা ভাবা হয় তবে পুরো পাকিস্তানকে সাত বার বিক্রি করলেও তাঁর মস্তিষ্কের দাম  উঠবে না৷ আর যদি মানবিকতার মূল্যে তাঁকে মূল‍্যায়ন করি তবে সমগ্র পাকিস্তানের একজনও নেই যার সাথে তুলনা করা যাবে। এমনকি ফজলে রাব্বি হতে পারতেন বাংলাদেশের  প্রথম  নোবেলজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ১৯৭১ এর ১৪-ই ডিসেম্বর হানাদারদের এদেশীয় সহযোগীদের কারণে নির্মমভাবে হত্যার শিকার না হলে তিনি হয়তো চিকিৎসাবিজ্ঞানে এদেশের মুখ উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলতেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস  চূড়ান্ত পরীক্ষায়  শীর্ষস্থান অধিকারী ছাত্র ছিলেন এই ফজলে।    মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি মেডিসিনের উপর তাঁর বিখ্যাত  কেস স্টাডি লিখেন-  ‘A case of congenital hyperbilirubinaemia ( DUBIN-JOHNSON SYNDROME) in Pakistan’ নামে যা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিলে  বিশ্ব বিখ্যাত  মেডিক্যাল গবেষণা জার্নাল ‘জার্নাল অব ট্রপিক্যাল  মেডিসিন হাইজিন’-এ। 

১৯৭০ সালে তাঁর বয়স যখন মাত্রই ৩৮ বছর তখন তাঁর বিশ্বখ্যাত  গবেষণা Spirometry in tropical pulmonary eosinophilia প্রকাশিত হয়েছিলো বিখ্যাত ‘ব্রিটিশ জার্নাল অফ দা ডিসিস অফ চেস্ট  ও ল্যান্সেট’- এ। 

একই বছর ডাঃ ফজলে রাব্বি মনোনীত হয়েছিলেন পাকিস্তানের সেরা অধ্যাপক পুরস্কারের জন্য। কিন্তু  তাঁর আত্মায় ছিলো বাংলার অসহায় মানুষদের প্রতি প্রবল ভালবাসা, আর পাকিস্তানি শোষকদের প্রতি তীব্র ঘ্রণা। আর তাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন তিনি সেই পুরস্কার। 

১৯৭১ সালে ৩৯ বছর বয়সী ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে নিয়োজিত হন যা আজকের দিনে কল্পনাও করা যায় না যে এই বয়সেই কেউ এমন একটা অবস্থানে থাকতে পারে!

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি মেডিকেলে বসেই আহত মানুষদের সেবা দিয়েছেন। অনেকবারই তিনি নিজের সাধ্যের চেয়েও বেশী ঔষধ আর অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের  পরিচয় গোপন রেখে তাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলে আবারও যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়েছেন। 

মুক্তিযুদ্ধের  ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর টানা দুই রাত ডাঃ ফজলে রাব্বির স্ত্রী জাহানারা রাব্বী  একই স্বপ্ন দুবার  দেখলেন। স্বপ্নে তিনি তাঁর তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে  সাদা সুতির চাদর গায়ে দিয়ে এমন একটা জায়গায় জিয়ারত করছেন যেখানে চারটি কালো থামের মাঝখানে সাদা চাদরে ঘেরা কি যেন একটা।

১৫ই ডিসেম্বর সকালে জাহানারা রাব্বী উনার দেখা স্বপ্নের কথা বললেন স্বামী ডা. ফজলে রাব্বিকে। রাব্বি বললেন, ‘হতে পারে তুমি স্বপ্নে আমার কবর দেখেছ’। এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন জাহানারা রাব্বি। তিনি  টেলিফোন টেনে এনে পরিচিত অধ্যাপকদের বাড়িতে ফোন করতে বললেন যাতে পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু খোঁজ নেয়া যায়। ফজলে রাব্বি অনেককেই ফোন করলেন, কিন্তু কাউকেও লাইনে পাওয়া যায় নি। 

ডা. ফজলে রাব্বী ও জাহানারা রাব্বী

আকাশে তখন ভারতীয় যুদ্ধবিমান তার দামামা বাজাচ্ছে। রকেট, শেলের শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা প্রায়। প্রতিদিনের মতো সকাল ১০টায় ২ ঘন্টার জন্য  কারফিউ উঠলে  ফজলে রাব্বি স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘একজন অবাঙালি রোগী দেখতে যাবো পুরান ঢাকায়।’  একথা শুনে বাইরে যেতে মানা করলেন জাহানারা রাব্বি। উনি মানছেন না দেখে বেশ তর্কাতর্কি হবার এক পর্যায়ে ফজলে রাব্বি বলেছিলেন ‘ভুলে যেয়ো না, ওরাও মানুষ।’

সেদিন অবশ্য রোগী দেখে তিনি কারফিউ শুরু হওয়ার বেশ আগেই বাসায় ফিরেছিলেন।

আগের দিনের বাসি তরকারি দিয়ে দুপুরের খাবারটা শেষ করলেন কোন বিরক্তি ছাড়াই বরং ডা. ফজলে রাব্বি উল্টো এমন দিনে একদিনের বাসি খাবারও অনেক ভালো খাবার বলে নিজের তৃপ্তি প্রকাশ করলেন। 

জাহানারা রাব্বি দেখলেন এখানে  থাকা বিপজ্জনক। তিনি বললেন, চলো চলে যাই।  ফজলে রাব্বি স্মিথ হেসে বলেছিলেন  ‘আচ্ছা, দুপুরটা একটু গড়িয়ে নিই। তারপরে না হয় কোথায় যাওয়া যায় সেটা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে’। 

কিছুক্ষণ পর বাবুর্চি এসে জানালো ‘সাহেব, হানাদারেরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে’।

বাইরে তখন কাদালেপা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে। মাইক্রোবাসের সামনে  রাজাকার, আলবদর আর হানাদারেরা।

খুব হালকা স্বরে ফজলে রাব্বি উনার ভয়ার্ত স্ত্রী জাহানারা রাব্বিকে বলেছিলেন, ‘ভয় পেও না, ওরা আমাকে নিতে এসেছে, আমাকে যেতে হবে’ বলেই দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বলেছিলেন আমাদের  তিনি। ১৫ তারিখ বিকাল ৪ টায় যখন মাইক্রোবাসে তিনি উঠলেন এটাই ছিলো পরিবারের সদস্যদের সাথে  তাঁর শেষ দেখা।

১৮ই ডিসেম্বর ডাঃ ফজলে রাব্বির লাশটি পাওয়া গিয়েছিলো  রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। তাঁর দুটি চোখ উপড়ে ফেলেছিলো অমানুষের দলেরা। সমগ্র  শরীরে জুড়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করার চিহ্ন।  গামছা দিয়ে দুটো হাত বেধে রাখা হয়েছিলো, লুঙ্গিটা উরুর উপরে আটকে ছিলো। সারাজীবন যিনি অন্যের হৃদযন্ত্রের চিকিৎসা দিয়েছেন কলিজাভরা ভালবাসা আর সাহস নিয়ে সেই মানুষটার হৃদপিন্ড আর কলিজাটা ছিঁড়ে  ফেলেছিলো বর্বর হানাদার ও নিকৃষ্ট  আলবদরেরা।

এই সেই ডাঃ ফজলে রাব্বি, যাঁর  গোটা হৃদয় জুড়ে ছিলো বাংলাদেশ  আর এদেশের অসহায় মানুষের প্রতি প্রবল ভালবাসা আর মমতা। যার হৃদয় জুড়ে ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের স্বপ্ন। হানাদার ও আল বদরের ঘৃণ্য  নরপিশাচেরা সেই হৃদয়কে ছিঁড়ে ফেললেও এই বাংলার মানুষের হৃদয় থেকে কি তাঁকে  বিছিন্ন করা যায় নি। যাবে না। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বির স্মরণে ও সম্মানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১৯৭২ সালে ‘ শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বি হল’  নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়।

হাজার বছর পরেও ডাঃ ফজলে রাব্বি থাকবেন আমাদের প্রাণে, হৃদয়ের গহীনে অমলিন, অমর এক মানবিকতার বিশুদ্ধ নাম হয়ে।  

আজ কিংবদন্তি চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবি শহীদ অধ্যাপক ডাঃ ফজলে রাব্বির জন্মদিন। জন্মদিনে নতচিত্তে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কিংবদন্তি চিকিৎসককে। আমাদের ফজলে রাব্বির মহান আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, দোয়া করি আল্লাহপাক যেন বেহেশত নসীব করেন।  আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *