রাউল গঞ্জালেস ব্লাংকো: রিয়াল মাদ্রিদের ভুলে যাওয়া এক নাবিক

মাদ্রিদের প্রতীক হয়ে উঠা রাউলকে মিস করার আগে তার খেলা দেখতে হবে, তার প্যাশন, তার হার না মানা মানসিকতার চেয়েও দলকে জিতিয়ে ফেরার মানসিকতাকে সর্বাগ্রে অনুধাবন করেই তবে আপনাকে বুঝতে হবে difference between a legacy illustrator and a legend!! 

রাউল মাদ্রিদ

হার না মানা মানসিকতা আর দলকে জিতিয়ে ফেরার মানসিকতার মাঝে যতটা ফারাক, রন আর রাউলের মাঝে ঠিক ততোটাই ফারাক!! রন যেখানে মাদ্রিদ লেজেন্ড সেখানে রাউল লিজেন্ড তো অবশ্যই তার উপর সে মাদ্রিদের লিগ্যাসি বিয়ারার!! এজন্যই সে হয়ে উঠেছিলো মাদ্রিদের অন্য নাম, রিয়াল মাদ্রিদের রাউল মাদ্রিদ হয়ে উঠায় কে বড় হলো সেটা বিতর্কিত ব্যাপার হতে পারে কিন্তু কেউ-ই যে ছোট হয় নি সে ব্যাপারে এই আদমি ওয়াকেফ। 
কথা হচ্ছিলো মানসিকতার, আমরা সবাই জানি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কখনোই হার মানেন না, নিজেকে নিজেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, আবার সেই চ্যালেঞ্জ জিতেই আবার সদর্পে ঘোষণা করেন নিজের সিগনেচার!! গোলের বন্যায় ভাসিয়েছেন বার্নাব্যু থেকে ন্যু-ক্যাম্পের ঘাস। হয়েছেন মাদ্রিদের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার। কি লীগে, কি উচলে, কি ক্লাব বিশ্বকাপে আর আন্তর্জাতিক ফুটবলে কি করেছেন তা অবশ্য আলাদা করে বলতে হবে না। যেখানে রাউল সব যায়গায় তার পেছনে, হালে তো করিম বেঞ্জেমাও উনাকে উচলে পেরিয়ে গেলেন।
এসব তো গেলো সব সংখ্যার হিসাব, যে যোগফলের সাধ্য নেই রাউলকে বর্ণনা করে। পরিসংখ্যান যেখানে অনেকের মাহাত্ম্য প্রচার করে সেই একই জিনিস কারো কারো কাছে এসে নিতান্তই ক্লিশে হয়ে যায়।

রাউল ও মাদ্রিদিজম

যদিও ঠিক এই জায়গাতেই অনেকেই রাউলের গোলের সাথে রনের গোলের সংখ্যা দিয়ে বিচার করতে গিয়ে নিরঙ্কুশভাবেই রনের পক্ষে রায় দিয়ে দেয় অথচ তারা জানেও না (দুঃখিত, কারো মাদ্রিদিজমকে ছোট করার জন্য বলি নি) রাউলের একেকটা গোল শুধু সংখ্যার বিচারে পরিমাপ করতে গেলে কত বড় ভুল হবে!! রন যেখানে গোলের জন্য মরিয়া ছিলো রাউল সেখানে আর্মব্যান্ডের লিগ্যাসি মেনে ক্যাপ্টেন্স নক দিয়ে দলকে জিতিয়ে প্যাভিলিয়নে পথ ধরায় বিশ্বাসী ছিলেন। রাউল কখনোই রনের মতো ডেডলি বা লিথ্যাল ছিলো না, এটা এক বাক্যেই মেনে নিতে পারি কিন্তু রাউল একজন ক্যাপ্টেন, একজন মেন্টর, একজন অসীম সাহসী সেনাপতি ছিলেন যিনি যুদ্ধে কখনো রাবণ কখনো রাম কখনো সুগ্রীব কখনো বা মেঘনাদ।
ধান ভানতে শিবের গীত গাইবার অভ্যাসটা আমার পুরনো, রাউলের সাথে ক্রিস কিংবা বেঞ্জেমার তুলনা নয় আসলে মোটাদাগে রাউলের সাথে রনের তুলনায় হাল আমলের মাদ্রিদ সমর্থকদের রোনালদো প্রীতি কিছুটা বেখাপ্পা লাগে আজকাল। একজন লা ফ্যাব্রিকান আর স্কাউটিং করে পাওয়া একজনকে অন্য একটা দল সুপারস্টার বানিয়ে দেয়ার পর সান লরেঞ্জো কর্তৃক কিনে এনে তার থেকে পাওয়া সার্ভিসটাতে আপনি মোটাদাগে ট্রেইড এন্ড কমার্সের খতিয়ান ও চুড়ান্ত হিসাব মিলাতে পারবেন, নিদেনপক্ষে মাদ্রিদিস্তা ট্যাগ দিয়ে তাকে বুকে টানতে পারবেন কিন্তু মাদ্রিদিজমের পতাকাবাহী এক সেনাপতির সাথে মেলাতে গেলেই গোলের উপর ডঙ্কা বেজে উঠে।
দয়া করে সিআর-৭ অন্তপ্রান ভক্তেরা আমার কথায় আঘাত পাবার আগে আমার টাইমলাইন ঘুরে আসলেই বুঝবেন আমিও ক্রিস্টিয়ানো ভক্তদের দলে একদম ফেলনা কাগজ হবো না!!

রাউল গঞ্জালেস

রাউলের রাউল মাদ্রিদ হয়ে উঠার শুরু

যাই হোক, মূল প্রবন্ধে ফিরে আসি, অবশ্য রাউল গঞ্জালেস ব্লাংকোকে নিয়ে একটা লামসাম প্রবন্ধ লেখার যোগ্যতাও আমার নেই, তবুও নিজের অনুভূতি আর আবেগের সাথে সামান্য যুক্তির প্রলেপ মিশিয়ে কিছু একটা জগাখিচুড়ি বানিয়ে দেয়ার সাহস নিয়েই বসে গেলাম। বস্তুত ভালবাসার কাচ্চি যেমন উপাদেয় তেমনি ভালবাসার পাতলা খিচুড়িও জিভের ধার কমাবে না বিশ্বাস থেকেই লেখা শুরু করে দিলাম।
সময়টা ১৯৯৪-২০১০, এই ১৬ বছরের মধ্যে আমি রাউলকে চিনি ২০০২ থেকে, আর কিছুটা বুঝি ২০০৪ থেকে আর মোটামুটি ভালোই বুঝি যদি বলি তবে সেটা ২০০৬-২০১০ এই ৫ বছরে। এই শেষ অর্ধ দশকে তার ফর্ম ছিলো পড়তির দিকে(এই পড়তি মুলত মাদ্রিদের জন্য, অন্য অনেক দলই এই পড়তি ফর্মের রাউলকেই বুকে তুলে নেবার জন্য হাপিত্যেশ করেছে), তবুও এই পড়ন্ত বেলার রাউলকে দেখেও আপনি তার প্রেমে পড়বেন, শুধু মাঠে তার সবকিছু ঢেলে দিয়ে মাঠের মাদ্রিদকে আগলে রাখার প্রয়াস দেখেই।
চলুন এবার একটু শুরুটা শেষ করে আসি!!
হোর্হে ভালদানোকে আশা করি সবারই মনে আছে, তিনি তখনকার সময়ের অন্যতম সেরা কোচ, সাথে এমিলি বুত্রাগুয়েনা মাদ্রিদের অন্যতম নাম্বার সেভেন, যার অফ ফর্মের কারণেই ভালদানো এই কিশোর লা ফ্যাব্রিকানকে মাথায় আনেন এবং তাকে খেলাবেন বলেই স্থির করার পর তাকে আগেই জানাবেন বলে ঠিক করেন যাতে নার্ভাসনেসে না ভুগেন। লীগের নবম ম্যাচ রিয়াল জারাগোজার বিপক্ষে, ম্যাচের আগেই ভালদানো বলেন, “রাউল, অভিষেকের জন্য প্রস্তুত হও। সব সময়ের শান্ত ক্যাডেট, যে কিনা সারাজীবন ভদ্রতা ও গাম্ভীর্যের মিশেলে নিজেকে আগলে রাখতেন সেই রাউলই শান্ত কিন্তু দৃঢ়ভাবে বললেন, ” তুমি যদি জিততে চাও তবে আমাকে খেলাও, আর না জিততে চাইলে তোমার খুশিমতো যে কাউকেই খেলাতে পারো”।

১৭ বছর ১২৪ দিন। মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে দুঃস্বপ্নের অভিষেক হল রাউলের। দুঃস্বপ্নের এজন্য যে কোচের কাছে নিজেকে নিয়ে এতোটা দর্প দেখানো কিশোরের দর্প চুর্ণ হওয়াটা তার কিশোর মনে কি আলোড়ন তুলেছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আরো ভেঙে চুরমার হবার কথা যখন জানবেন বদলি হিসেবে নামা এই কিশোর গোলরক্ষককে একা পেয়েও তিনটি সুযোগ অবিশ্বাস্যভাবে মিস করেন। তার দলও ম্যাচটা হেরে যায় ২-৩ ব্যবধানে। সবাই ভেবেছিলো রাউল কান্নাকাটি করে নিশ্চয়ই ড্রেসিংরুম কাদামাটি বানিয়ে ফেলবে কিন্তু না, একদম চুপ মেরে বসে থাকা রাউলকে স্বান্তনা দিতে যাওয়া সহকারী কোচের কাছে বললেন, “আমি আরেকটা ম্যাচ খেলতে চাই, এই সুযোগটা কি আমাকে দেয়া যায়?”
পরের ম্যাচে সুযোগ পেলেন, তাও আবার বার্নাব্যুতে, মাদ্রিদ ডার্বিতে। ঘরের মাঠে নিজের শৈশবের ক্লাবের বিপক্ষে। ফাউলের শিকার হয়ে পেনাল্টি আদায়, জামেরানোর গোলে সহায়তা, তারপর নিজের প্রথম গোল, সব যেন কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নিলেন। বার্নাব্যুর দর্শকদের চোখে মায়াঞ্জন এঁকে দেয়া রাউল গঞ্জালেস ব্লাংকোর রাউল মাদ্রিদ হয়ে উঠার সুচনা সংগীতের সিম্ফনির সারগামের শুরু!!

নেতৃত্ব ও অর্জন

পরের ১৬ বছর ছিলো অর্জনের, দেয়াল হয়ে দাঁড়ানোর, বাঘা বাঘা সতীর্থদের পাশে নিয়েও নতমস্তকে কিন্তু চোয়াল শক্ত রেখে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসা, পাঞ্জেরী হয়ে বুক চিতিয়ে গিরিশৃঙ্গ হয়ে গ্যালাকটিকোর ভার বয়ে যাওয়ার মাঝেও ছিলো দৃঢ়তা আর কোমলতার মিশ্রণ। বার্নাব্যুতে তার প্রায় দেড়যুগের পথচলায় এতোটাই বুঁদ করে রেখেছিলেন যে ফুটবল বিশ্ব রিয়াল মাদ্রিদকে চিনেছিলো রাউল মাদ্রিদ হিসেবে। ভাবা যায় গ্যালাক্টিকো যুগের আগে তো বটেই, গ্যালাক্টিকো যুগেও জিদান, ফিগো, বেকহ্যাম, কার্লোস, রোনাল্ডোর মত কিংবদন্তীর মধ্যমণি হয়ে রাউল আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন বার্নাব্যুর কান্ডারী, পথ ভুলে যাওয়া রিয়াল মাদ্রিদের পাঞ্জেরী।

সমগ্র ক্যারিয়ারে একবারও লাল কার্ড না দেখা এই যাদুকর সাত নাম্বার জার্সির লিগ্যাসিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলের ঐতিহ্যবাহী ৯, ১০, ১১ এর চাইতেও রোমাঞ্চকর এক জায়গায়, যার ভার বইতে এসে নুয়ে পড়েছিলেন অনেক রথী-মহারথীরাও।একে একে আমাঞ্চিও, হুয়ানিতো, বুত্রাগুয়েনোর পর রিয়ালের বিখ্যাত এই নাম্বার সেভেনের যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন। ৭৪১ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৩২৩ গোল করার এই দীর্ঘযাত্রায় ভেঙেছেন কিংবদন্তী ডি স্তেফানোর ৪৫ বছরের পুরনো ক্লাব রেকর্ড। অথচ সেই অর্থে কখনোই সেন্টার ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকার কোনটাই ছিলেন না।

হিয়েরোর বাহু থেকে নিজ বাহুতে নিয়ে পরের ৮টি বছর বয়ে গিয়েছিলেন মাদ্রিদের পর্বতপ্রমাণ ক্যাপ্টেন্সির ভার যখন তার সাথে একই পিচে বল নিয়ে যাদু দেখিয়েছেন রোনালদো ফেনোফেনন, জিদান, ফিগো, বেকহ্যাম, রবার্তো কার্লোস, মরিয়েন্তেসদের মতো পোড় খাওয়া সুপারস্টারগণ পাশাপাশি নিজের বাহুডোরে জায়গা দিয়েছেন নিস্তেলরুই, ওয়েন, হিগুয়েইন, স্নেইডার, রোবেন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের মতো উঠতি তারকাদের। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে মাদ্রিদ ও অন্যান্য ক্লাবের হয়ে ফুল ফুটিয়েছিলেন। এদের মধ্যে সিআর নাইন তো তার নাম্বার সেভেনকে নিয়ে গিয়েছেন আরো অনন্য উচ্চতায় আর হয়ে উঠেছেন মাদ্রিদের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোল স্কোরার (তাঁকে নিয়ে মহাকাব্য লিখা যায়, সেটা আমার কম্মো নয় বাবা!!)

রাউল গঞ্জালেস

কি ছিলো রাউলে?

দুর্দান্ত এই রাউলে কেন বারবার ভরসা করতেন সবাই? এমনকি স্পেন জাতীয় দলেও তার একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে উঠাও চাট্টিখানি কথা নয় তো!! কি ছিলো এই রাউলের? কেমন ছিলেন তিনি? দুর্দান্ত গতিময় ছিলেন? ড্রিবলিংয়ে অনন্যতা? উন্নত টেকনিক?আমার কাছে কখনোই মনে হয় নি! গতিতে ফিগো বা মরিয়েন্তেস থেকেও কম ছিলেন। ড্রিবলিং?জিদান তো তার সামনেই ছিলো নাকি? আর টেকনিক? ও প্লিজ, রোনালদো কিংবা বেকহ্যাম থাকতে রাউল? তাহলে কি ছিলো তার? কোথায় তিনি আলাদা ছিলেন? আসুন তো একটু মিলিয়ে দেখি!!
আমার চোখে তার ফার্স্ট টাচ ছিলো দেখার মতো, এতো সুন্দর করে পোষ মানানো বল রিসিভ আর সাথে সাথে ক্লিয়ারেন্স কিংবা অন পোস্টে শট স্বয়ং ফেনোমেননও নিতে পারতেন না মনে হয়। এ-তো গেলো ফার্স্ট টাচ, এটা তার সিগনেচার আইটেম ছিলো। আর সেকেন্ডলি যা ছিলো সেটা হলো একটা মস্তিষ্ক, একটা এক্সট্রিম ভিশনারি ব্রেন ছিলো তার। মুহুর্তেই বল পায়ে ম্যাচ পড়ে নেয়া, পরের টাচটা কোথায় হবে আর কোথায় যাবে বল সেটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতেন চকিত শটে। বলা যায় মোটামুটি ধরনের এসব গুনের সাথে ভিশনারি ব্রেনের কম্বিনেশনই তাকে পরিসংখ্যানের মাপে মাদ্রিদের দ্বিতীয় সেরা লিজেন্ড আর তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের তৃতীয় সেরা বানিয়ে দিয়েছে।

রাউলের দক্ষতা ও মাঠে তার দখলদারত্বের সংজ্ঞা বুঝতে হলে মাদ্রিদের সাবেক অধিনায়ক, হিয়েরোর মন্তব্যকে বুঝতে হবে, তার মতে”রাউল কোনটাতেই ১০/১০ ছিল না। তবে সবকিছুতেই ছিল ৮.৫/১০। যেটা ওকে সেরাদের সেরা বানিয়েছে। পাশাপাশি দারুণ প্রথম টাচে ডিফেন্সকে হতভম্ব করে দেওয়া, দ্রুত ফিনিশিং, কিছু বুঝে ওঠার আগেই চকিত শটে নিশানা খুঁজে নেওয়া, সুযোগ তৈরি করা – জাত ফরোয়ার্ডের সব লক্ষণই ছিল রাউলের মাঝে”।
আর তার প্রথম গুরু ভালদানো রাউলকে পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত করে দিয়েছেন আমাদের কাছে। তার মতে,”ছেলেটার ট্যালেন্টের চেয়ে চাপ নেবার ক্ষমতা, ধৈর্য আর শান্ত ভাবটাই ওকে আলাদা করে দেয়।” ঠিক এই মন্তব্যেই রাউলকে পাবেন আপনি সবার চেয়ে আলাদা করে।

রিয়ালে শেষের শুরু

খেলোয়াড় হিসেবে অনেক কিছুই অর্জন করেছেন মাদ্রিদের হয়ে। পেশাদার ক্যারিয়ারে ৯৩২ ম্যাচে কখনো লাল কার্ড দেখেন নি এই পাংকচুয়াল মায়েস্ত্রো। এল ক্লাসিকোর উত্তাপেও শান্ত থেকে নিজের কাজ করে গিয়েছেন, ক্লাসিকোর ইতিহাসে ১৫ গোল নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার আর চতুর্থ খেলোয়াড় হয়েছেন এমন এক সময়ে যখন ক্লাসিকোতে সোনালী সময়ের বার্সার কাছে বারবার মার খেয়েছে মাদ্রিদ। তার শেষ গোলটা ক্লাসিকোর ইতিহাসে শিহরণ জাগানিয়া এক ম্যাচে। শুন্য দশকে শেষ যেবার রাউলের হাত ধরে লীগ জিতেছিলাম আমরা, সেবার এল ক্লাসিকোর আগের ম্যাচেই লীগ নিশ্চিত করায় পরের ম্যাচ, মানে ক্লাসিকোতে প্রথামাফিক গার্ড অফ অনার পাওয়ার কথা। বার্সেলোনা সেই প্রথা মেনেই গার্ড অফ অনার দিয়েছিলো, তাও কোথায়? আমাদের বার্নাব্যুতে, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সাদা আর্মির ডেরায়!!
যে ম্যাচে রাউলের দেখানো পথে একে একে রোবেন, হিগুয়েইন ও নিস্তেলরুইয়ের মতো তরুণ তুর্কিদের গোল উৎসবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ এক লীগ জয়ের মধুরেণসমাপয়েৎ ঘটে। ফুটবলের এই নিরব এই ঘাতক কিন্তু এল ক্লাসিকোতে গোলের পাশাপাশি একদম শান্ত থেকে সতীর্থ ও বার্সার খেলোয়াড়দেরও শান্ত করতে ভুমিকা পালন করতেও ছিলেন তৎপর।

হালের উয়েফা ক্রিস্টিয়ানো লীগ বলে উচ্চকিত ফ্যানদের কাছে হয়তো আগ্রহের বিষয় নয় তবে এই রাউলই এক সময়ে টপ স্কোরার ছিলো ইউসিএলের। চ্যাম্পিয়নস লীগ টুর্নামেন্টের ইতিহাসের সেরাদের একজন এই রাউল। এই রাউল ১৯৯৮-২০০২, ৫ বছরে ৩ বার দলকে ইউসিএল জেতানোর পাশাপাশি প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ২০০০ ও ২০০২ এর দুটি ফাইনালে গোল করেছেন । দুটো গোলই কিন্তু আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্রথমটি তো চোখ জুড়ানো, নিজেদের অর্ধের ভেতর থেকে প্রায় ৫০ গজ দৌড়ে কিপারকে কাটিয়ে ধৈর্যের ফল পাওয়া এক গোল, আরেকটি আপাত নিরীহ এক থ্রো-ইন থেকে ডিফেন্সকে বোকা বানানো চকিত দৌড় আর দ্রুত সেই সিগনেচার ফার্স্ট টাচের ফিনিশিং। জিদান সব আলো কেড়ে নিলেও এই গোলের সৌন্দর্যও আপনি ফেলে দিতে পারবেন না। 

ক্যারিয়ার যতি টানার আগ পর্যন্ত ছিলেন চ্যাম্পিয়নস লীগ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। দুবার মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল, আর তিনবার মৌসুম সেরা ফরোয়ার্ড। যার পুরস্কার হিসেবে সর্বকালের সেরা চ্যাম্পিয়নস লীগ একাদশে তাঁর জায়গা পাওয়া। 

রাউল মাদ্রিদ

১৬ বছর! ৭৪১ ম্যাচ!! ৩২৩ গোল!!!

মাদ্রিদের শোকেসে দিয়েছেন ৬ লীগ, ৩ চ্যাম্পিয়নস লীগ আর দুটো ইন্টার কন্টিনেন্টাল শিরোপা।
প্রবল পেশাদারত্বের নিশানা উড়িয়ে বার্নাব্যুকে বিদায় জানিয়েছেন যখন তার নিজের মনে হয়েছে এই পিচে আর নয়, তার সময় ফুড়িয়েছে। অথচ তার পরের গন্তব্যগুলোতেও নিজের চিহ্ন রেখে এসেছেন রাউলসুলভ। মাদ্রিদিস্তাদের কাঁদিয়ে ২০১০ এ ক্যাসিয়াস নামক আরেক কিংবদন্তির বাহুতে ভার দিয়ে যান মাদ্রিদ ডিএনএ বয়ে নেবার।
শালকেতে যোগ দেন আমাদের রাউল, নিজেকে নিজেই মাদ্রিদের জন্য অযোগ্য মনে করে মাদ্রিদ হতে বিদায় নেয়া আমাদের রাউলের জন্য একটা তথ্যই জানিয়ে দিবো, সেটা হলো তার দুই বছরের শালকে ক্যারিয়ারে তার সম্মানে সাত নাম্বার জার্সিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবসরে পাঠিয়েছিলো ক্লাব কর্তাগণ। কেন? শালকের ইতিহাসের অনন্য কিছু অর্জন এসেছিলো আমাদের রাউলের হাত ধরে।

এই ছিলো আমাদের রাউল, যাকে খুব শীঘ্রই আমাদের ডাগ আউটে দেখার বড্ড সাধ আমার!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *