অন্তর্মুখী

যাদের আমরা ইন্ট্রোভার্ট বলি

মহাত্মা গান্ধী, বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভেন স্পিলবার্গ, আইজ্যাক নিউটন, এই নামগুলো তো সবাই জানেন, জানেন না? এরা প্রত্যেকেই নিজ কর্ম ও গুণে পৃথিবীতে ইতিহাস তৈরি করে গিয়েছেন। এদের প্রত্যেকের মাঝেই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা গুণ ছিলো। জানেন সেটা কি? তারা প্রত্যেকেই অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলো। তারা নিজেদের কাজ ছাড়া অন্যদের কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। অন্যদের পর্যবেক্ষণ করতেন, দেখতেন, বুঝতেন কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে কোন কথা বলতেন না। কেন জানেন? অন্তর্মুখী বা ইন্ট্রোভার্ট মানুষ হওয়া কোন সমস্যা বা রোগ নয় বরং এটা এমন একটা গুণ যা এই পৃথিবীতে আপনাকে অন্য একটা বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত করবে। হয়তো ভাবছেন আশেপাশের সবাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে আর উনি এসে কিনা আলাপ জুড়েছেন বিশেষ গুণের। আরে আগে শুনুন, ভাবুন, নিজেকে জানুন তারপর আপনিই বলবেন আমি তো সবচেয়ে পরিশীলিত, অন্যদের চেয়ে অনেক স্মার্ট আর আলাদা। এখন আসুন আপনি কেন আলাদা সেই আলাপ করি। তার আগে একজন অন্তর্মুখী বা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মানুষ হিসেবে আসুন দেখি আপনি কি করেন আর কি করেন না তার হিসাব এবং তার প্রভাবটা কি তার তূলনামূলক বিশ্লেষণ করি চলুন।

ইন্ট্রোভার্ট’রা যা করে না:


১. অতিরিক্ত কথা বলি না, আমরা চুপচাপ না, আমরা হুদাই চিল্লাই না!
২. আমরা না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত নিই না, আমরা ঝোকের বশে কিছু করে বসি না।
৩. আমরা সাধারণত মুরব্বীদের সাথে ভুল করেও বেয়াদবি করি না, প্রয়োজন ছাড়া তাদের আলাপচারিতায় উপস্থিত থাকি না।
৪. আমরা সময় নষ্ট করি না, সাধারণত আড্ডাবাজি বা অকারণ আলাপে মেতে থেকে সময়ের বারোটা বাজাই না।
৫. আমরা আমাদের অফিসে কাজ করতে বসে কাজের চাপে বসদের পিন্ডি চটকাই না, কাউকে অভিশাপ দেই না।
৬. আমাদের জুনিয়র বন্ধু বা কলিগদের ভালো কাজের প্রশংসা না করে থাকি না।
৭. আমরা অতিরিক্ত বায়না ধরি না, বাবা-মায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে কিছু আদায় করি না।
৮. আমাদের নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসে না, কারো সাথে ঝগড়াঝাটি করার মতো মুড আমাদের নাই
৯. আমাদের কোন বন্ধু বা সহপাঠী পরীক্ষায় বা কোন কাজে খারাপ করলে আমরা তাদের নিয়ে হাসাহাসি করি না।
১০. আমরা বন্ধু হতে চাই, বন্ধু বানাতে চাই কিন্তু কখনোই বন্ধুত্বের সুযোগ নেই না।

অন্তর্মুখীতা কোন রোগ নয়

ইন্ট্রোভার্ট’রা যা করে


১. আমরা নিজেদের জীবনীশক্তি জমিয়ে রাখি, সবাইকে নিয়ে ভাবি আর এই ভাবনাগুলো কাজে পরিণত করার মাধ্যমে সেটার জানান দেই।
২. আমরা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিই আবার সেই অনুযায়ী গুছিয়ে কাজ করি বলে সেই কাজ সুন্দর হয়। তাই আমরা মোটিভেশনাল বক্তা না হলেও তাদের বক্তব্যে অন্যদের মোটিভেট করার উদাহরণ হিসেবে আমাদেরই কারো না কারো নাম নিয়ে থাকেন।
৩. আমরা প্রচুর বই পড়ি, মুভি দেখি, মানুষদের আন্তঃব্যক্তি আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে পারি বলে আমরা যখন কারো সাথে কথা বলি তখন সেটা অনেক আকর্ষণীয় ও শ্রুতিমধুর হয় বলেই আমরা কথা বললে অন্যরা মনোযোগ দিয়ে শুনে। বলা যায় আমাদের মুখনিঃসৃত কথা অন্যদের কাছে মুক্তোঝরানো হয়ে থাকে।
৪. চুপচাপ নিজের কাজটি করি বলে ক্লাসে আমাদের প্রজেক্টটা সবাইকে মুগ্ধ করে, তাই অনেকে হিংসে করে আমাদের, কিন্তু আমরা ভাব নিই না, বন্ধুত্ব ছড়িয়ে দিই, হাত বাড়িয়ে দিই বন্ধুত্বের। 
৫. কোন মেয়েকে ভালো লাগলে তাকে সম্মান দিই, উত্ত্যক্ত করি না, তাকে ভালবাসার কথা বলতে না পারলেও তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই।
৬. অফিসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করি, সময়মতো প্রজেক্ট সম্পন্ন করি, বসেদের কাছে ফাও স্মার্টনেস দেখিয়ে বড় না হয়ে কাজের দক্ষতা দিয়ে স্বীকৃতি আদায় করি।
৭. সংসারে অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেন, এমনকি পরিবারেও কম সমালোচনার মুখে পড়ি না, তবুও আমরা আমাদের কাজ দিয়ে তাদের লজ্জায় ফেলে না দিয়ে একটা সময় আমাদের মধ্যে তাদের প্রতি প্রবল ভালোবাসার জানান দিই। 
৮. আমাদের ছোটখাটো উপহার কিংবা পুরস্কার অথবা প্রশংসা করলেই আমরা অনেক খুশি হতে জানি, এমনকি যিনি এমন করলেন তার নামটা ভালবেসে মনে রাখি।
৯. যে বন্ধুটি, কিংবা সহকর্মীটি আমাদের বুলিং করে মজা নেয় কিংবা ছোট করে আনন্দ পায় আমরা তাদের কোন ক্ষতি চাই না, রাগ পুষে রাখি না। কখনো ভুল বুঝে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলে আমরা পুরো ব্যাপারটা বন্ধুত্বের ছায়ায় আড়াল করে মিষ্টি হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে তাদেরও আপন করতে জানি।
১০. আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে নিজেদের মধ্যে হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, নিজেকে ছোট ভাবার অনুভূতি আসলেও নিজেদের জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলি না। 

সর্বোপরি, আমরা বিশ্বাস করি অন্তর্মুখী হওয়া কোন সমস্যা নয়, কোন রোগ নয় এটা। বরং এটা বিশেষ গুণ যা মহান স্রষ্টা হতে আমাদের জন্য উপহার হিসেবে ভাবতে হবে। মনে রাখবেন আমাদের মতো পরার্থপরতা কেউ দেখাতে পারে নি এই জীবনে। তাজউদ্দীন আহমদকে মনে আছে নিশ্চয়ই যিনি আজীবন অন্তর্মুখী কিন্তু কি ইস্পাত-দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন ভাবুন তো! এপিজে আব্দুল কালাম আজাদের কথা নতুন করে কি বলবো বলুন? নিজ কর্মগুণে আজ উনি নিজ কীর্তি আর কাজ দিয়ে এই উপমহাদেশের সবার মনেই বেঁচে আছেন। ও হ্যাঁ, আমাদের সকলের প্রিয় সংগীত পরিচালক অস্কার জয়ী এ আর রাহমানের কথাও তো বাদ গেলো, উনিও কিন্তু আমাদের দলের লোক। শুধু নিজের উপর বিশ্বাস ও কাজের প্রতি মনোনিবেশ করে এগিয়ে যেতে পারলেই দেখবেন যারা আমাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করে সময় কাটিয়েছে তাদেরই একদিন সবাই অপমান করে আমাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলবে তাদের মতো হতে পারো নি কেন? ভাবা যায়!! আমরা নিজেদের কতটা হীনবল ভেবে বসে আছি কিন্তু আমরা যা পারি তা অন্যরা কোনভাবেই পারবে না। শুধু নিজের উপর ভরসা করুন, বিশ্বাস রাখুন নিজ সামর্থ্যের উপর। মনে রাখবেন সিংহ আর বাঘ শক্তিতে কাছাকাছি হলেও সিংহ বনের রাজা কারণ সে বাঘের মতো যখন তখন হালুম-হালুম করে না, সিংহ তখনই গর্জে উঠে যখন তার গর্জন ছাড়া বন শান্ত হবে না বলে মনে করে। আমরাও সিংহ, রাজা গোত্রীয় মানুষ আমরা। সিংহের কেশর হয় যখন তার মধ্যে পরিপক্বতা আসে তখন। যখন কেশর নাচিয়ে সিংহ হেলেদুলে হেটে যায়, বাকিরা পথ ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে সম্মানের চোখে। সুতরাং নিজের ভেতরের সিংহকে জাগিয়ে দিন, একটা সময় আমরা হেলেদুলে একাই এগিয়ে যাবো বাকিরা তাকিয়ে দেখবে আর ভাববে একে নিয়েই তো আমরা হাসাহাসি করতাম, বুলিং করতাম আর আজ কি না সে-ই আমাদের বস হয়ে অফিসে ঢুকছে? শুধু দরকার সহনশীলতা আর ধৈর্যের মিশেলে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার খেলায় মেতে উঠতে হবে। কে কি করলো তা না ভেবে নিজেকে গতকালের চেয়েও উন্নত করে তুলতে হবে। লিওনেল মেসিকে দেখুন, চুপচাপ নিজের কাজটি কিভাবে করে যেতে হয় তা শিখুন। আবার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দেখুন, মেসির টানা ব্যালন ডি অর জেতা নিয়ে তাকে কম সমালোচনা, হাসি-ঠাট্টার মুখে পড়তে হয় নি। অথচ নিজেকে ভেঙেছেন, আবার নতুন করে গড়ে তুলেছেন। আর তার ফল দেখুন কিভাবে হাতেনাতে পেলেন। এভাবেই নিজে কি পাচ্ছি কি পাচ্ছি না৷ কে হাসছে, কে বুলিং করছে এসব না ভেবে, না দেখে নিজেকে দেখুন, নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার মিশনে নামুন দেখবেন পৃথিবী আপনার আমার জন্য বিশাল করিডোর খুলে দিয়েছে, মহীরুহ বানিয়ে নিয়েছে আমাদের। কারণ, এই পৃথিবী নিজেও একটা অন্তর্মুখী স্বভাবের গোলক যে সবকিছুই নিজের দিকে টানে, নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হলেও সবাইকে আগলে রাখে। কারো আঘাত, কারো অনাসৃষ্টি একে দমাতে পারে না, বরং যারা এই গোলকের গায়ে ধ্বংসের বীজ বপণ করতে চায় তারাই ধ্বংস হয়।
শেষ করছি বিখ্যাত একজন অন্তর্মুখী মনীষী রবার্ট চার্লস ডারউইনের একটা বিখ্যাত  “Survival for the fittest” উক্তি দিয়ে যা মনে করিয়ে দেবে আপনি টিকে থাকতে চাইলে নিজেকে ফিট করলেই চলবে না শুধু আপনাকে হতে হবে ফিটেস্ট। Best among the betters.

সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
বিশ্বাস রাখুন নিজের উপর।

“বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিয়ে ছাড়িয়ে যাবো সবাইকে, এমনকি নিজেকেও”
সবার জন্য ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিক শুভকামনা!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *