মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত: মোজার্টের এক সিম্ফনি

যারা প্রকৃতিপ্রেমী, ভ্রমণপিপাসু, যারা প্রকৃতির মাঝে অনাবিল আনন্দ খুজতে চান কর্মক্লান্ত দিনগুলোর শেষে কিংবা নিজের একান্ত সময় প্রকৃতির কাছাকাছি কাটাতে চান তাদের জন্য মাধবকুণ্ড এক অনিন্দ্য সুন্দর ভালোবাসার নাম।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড:

পাথারিয়া পাহাড় বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির পতন যেন ষোড়শী কন্যার উচ্ছলিত খলখল হাসির শব্দ যেন।  এ যেন প্রকৃতিতে এক বাদ্যযন্ত্রের অপুর্ব সুর, মোৎজার্টের মন্দ্রসপ্তকের সিম্ফনিকে হার মানিয়ে দেয়া এক অনিন্দ্য সুন্দর প্রস্রবণ এই মাধবকুন্ড জলপ্রপাত।প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এ যেন শুভ্র জলরাশিতে নৃত্য করা কোন সাদা জলপরী। 

ভ্রমণপিয়াসীদের ক্লান্ত হৃদয়ের সকল প্রশান্তি এনে দেয় লাস্যময় মাধবকুণ্ডের এই জলকেলী।

বছরের প্রায় সব সময় ই পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে এই জলপ্রপাতটি। তবে বর্ষাকালে এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য যেন উছলে ওঠে। সৌন্দর্য ফুলেফেঁপে উঠে যেন, চোখ ফেরানো দায় হয়ে যায় প্রকৃতির টানে উদাস হওয়া বাউলদের। সারা বছর ই পানির ধারা অব্যাহত থাকলেও বর্ষাকালে পানির পরিমাণ ও তীব্রতা বেড়ে যায় এবং এই বিপুল জলরাশি পশ্চিমে হাকালুকি হাওরে মিশে যায়।

দেশের সর্ববৃহৎ এই জলপ্রপাতটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখার দক্ষিণভাগ গ্রামে অবস্থিত। পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে বেয়ে নেমে আসে এই বহমান স্রোতধারা।

Madhabkunda-Waterfalls
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত

প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচের দিকে অবিরাম ঝরে পড়ে পরিব্রাজকদের চোখে প্রকৃতির অমিয়সুধা ঢেলে দেয় এই সফেদ, সফেন জলরাশি। 

জলপ্রপাতের অবিরাম স্রোতের ধারায় শ্যাওলা, ছত্রাক ও অন্যান্য অনুজীবদের উপস্থিতিতে পাহাড়ের গা পুরোটাই কঠিন পাথুরে শিলায় পরিণত হয়ে পড়েছে।  আর নিচে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কালের বিশাল বড় বড় পাথরের সমাহার, যেখানে দর্শনার্থীরা দাঁড়িয়ে, বসে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে স্মৃতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখা যায়।

জলরাশির যে দিকে পানি পড়ছে তার বিপরীত দিকে বিশাল এক গুহা রয়েছে, যা খুবই দৃষ্টিনন্দন। কালো পাথুরে এই গুহা অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক কালের আদিম অধিবাসীদের উপস্থিতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। স্থানীয় অধিবাসীরা এই গুহাকে “কাব” বলে। অনেকটা গুহার ইংরেজি “কেইভ” শব্দের আঞ্চলিক রুপ বলা যায় আর কি!! পাথরের ভিতরে তৈরি গুহা-টি দেখতে আধুনিক বাংলোর প্রধান ফটকের মতো। মনে হবে বিশাল প্রাসাদে প্রবেশের জন্য একটা অর্ধবৃত্ত ফটক যেন কেউ বানিয়ে রেখেছে। গুহা-টি প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি হয়েছে বলে ধারনা করা হয় তবে অনেকেই মনে করেন এই গুহা-টি ঋষি মাধবেশ্বরের ধ্যানের জায়গা বা গোপন আস্তানা। এখানে বসেই তিনি ধ্যানে নিবিষ্ট হতেন বলে অনেকেই দাবি করেন। যদিও লোকমুখে প্রচলিত এই দাবি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে কিন্তু আসলে এটি কিভাবে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে এখনও রহস্য রয়েছে।

মাধবকুন্ড যাবার পথে সবুজ মখমলের চাদর

Tea Gardens
চা বাগানের সবুজ অরণ্য

মাধবকুণ্ড আসার পথে চোখে পড়বে উঁচু নিচু টিলার ভাজে ভাজে সবুজ মনোরম চা বাগান। সুপারি গাছ পেচিয়ে বেয়ে উঠা চোখ জোড়ানো  খাসিয়াদের সবুজ পানের বরজ।

মনে হবে এ যেন বিশাল আকাশের নিচে এক খন্ড সবুজ মখমলের চাদর।

মাধবকুণ্ড নামের সাথে জড়িয়ে আছে এক পৌরানিক কাহিনী, কথিত আছে পুরাকালে মাধবেশ্বর গৌরী দেহান্তরিত হলে প্রেয়সীর বিরহে মহাদেব শবদেহ নিয়ে অনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

তার এই যাত্রায় গৌরীর দেহাবশেষ যেখানে পড়েছে সেখানেই তীর্থক্ষেত্র সৃষ্টিহয়েছে। পাথারিয়াতে গৌরি দেহের এক অংশ পড়েছে এই ধারনা থেকেই এই জায়গা কে তীর্থস্থান হিসাবে মানা হয়। 

তবে এ গুহাটি আসলে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে এখনো রহস্য রয়েছে।

যাতায়াত ব্যবস্থা:

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার কাঠালতলী বাজার থেকে মাত্র ৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ জলপ্রপাতটি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকেই সড়ক পথে অথবা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে ও আসা যায়।এখানে আসার জন্য শুধুমাত্র একটু সময় ও সুযোগ করে নিতে হবে।

দেশের যে কোন রেল স্টেশন থেকে কুলাউড়া গামী আন্তঃনগর ট্রেনে চেপে নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন এখানে। চট্টগ্রামের জন্য রয়েছে বি. আর. টি. সি এর বাস। 

শুধু তাই নয়,ঢাকা এবং উত্তরাঞ্চলের জন্য রয়েছে শ্যমলী পরিবহনের বাস যা সরাসরি বড়লেখায় আসে। নির্মল প্রকৃতির কাছাকাছি আসতে তাহলে আর বাঁধা কোথায়?

শুধু কি আসা যাওয়ার ব্যবস্থা? 

রাত্রি যাপনের জন্য দেশি বিদেশি পর্যটকেদর জন্য রয়েছে ডাক বাংলো।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এখানে রাত্রিযাপনের সুবিধা পাওয়া যায়। এ ছাড়া ও জেলা শহরে আধুনিক সুবিধাসম্মন্ন হোটেল কিংবা রিসোর্ট তো আছেই।

শিশির বিন্দু

Dew Drops on Tea Leaves
চায়ের পাতায় শিশির বিন্দু

তাই কবি গুরুর ভাষায় ধানের শীষের উপর শিশির বিন্দু নাইবা দেখলেন, তাই বলে কি আকাশের বুকে যে পাহাড় ঘুমিয়ে আছে,সেই পাহাড়ের  সাদা জলরাশি  উপেক্ষা করা যায়?

তাহলে আর দেরী কেন? নানা রুপের পসরা সাজিয়ে পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যান্ত্রিক কোলাহল কিংবা কাজের চাপ থেকে নিজেকে একটু প্রশান্তি দিতে প্রকৃতির কাছাকাছি, মাটির টানে চলে আসুন, নির্মল জলের হাওয়ার স্পর্শ নিয়ে ফিরে যান আপন ভুবনে নতুন এক আপনি হয়ে।

মনোরম, অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ি ঝর্ণার নৃত্য, খাসিয়াদের জীবনধারা আর চা বাগানের সবুজের সমারোহে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে ঘুরে আসতে পারেন মৌলভীবাজার এর মাধবকুণ্ড।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *