ফিলিস্তিন: পশ্চিমা বিশ্বের নির্লজ্জ লভ্যাংশ

ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে তা কি হতেই থাকবে? আল আকসার ভেতরে ও বাইরে ইসরায়েলি হামলার কয়েকটা ভিডিও দেখে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি বলা যায়, মসজিদ মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয় আর বায়তুল মুকাদ্দাস হলো তাদের প্রথম ক্বিবলা যার দরুন এই পবিত্র ভুমির প্রতি স্বাভাবিকভাবেই সব মুসলমানদের গভীর আবেগ কাজ করবে । মসজিদ আল্লাহর ঘর, তার উপর জড় পদার্থ, ভেঙে গেলে আল্লাহর সহায়তায় আবার ঠিক করতে পারবো সবাই মিলে, পূর্বেও এটি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে আবার নতুন কলেবরে ফিরে এসেছে। কিন্তু যেভাবে গ্যাস বোম্ব, রাবার বুলেট ছোড়া হচ্ছে তা দেখে মনে হবে ফসলি জমিতে কীটনাশক ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে পোকামাকড় মারার জন্য। কতটা নিষ্ঠুর আর অমানুষ হলে এমনটা করা যেতে পারে তা ভাবলে আমি নিজে আর মানুষ থাকি না। ইসরায়েল মারছে ফিলিস্তিনিরা মরছে। বাকিরা ব্যাডমিন্টন খেলা দেখার মতো একবার ডানে আর একবার বামে তাকিয়ে শাটলককের অবস্থান দেখছি। কেউ কেউ কষ্ট পাচ্ছি, আস্ফালন করছি, কেউ কেউ হাততালি দিচ্ছি। আবার এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে আয়োজকেরা লাভের হিসাব করে, স্পনসরদের মাথায় ঘুরে সর্বোচ্চ পাবলিসিটি হলো কি না? পাশাপাশি বাজিকরদের বিভিন্ন অফারে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টাও চলে পর্দার আড়ালে।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের এই খেলাতেও কিছু বাজিকর আছে যারা এই মানুষগুলোর রক্তের উপর, চোখে আটকে থাকা বিভীষিকার উপর, জীবনের উপর বাজি ধরছে নিয়মিত। যাকে আমরা বৈশ্বিক রাজনীতি নাম দিয়েছি, সে রাজনীতির একটা অংশ মুসলিম বিশ্ব বা মোটাদাগে আরব বিশ্ব বা মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকার কিছু আরবিভাষী দেশ। অপরদিকে আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিশালী বেশ কয়েকটা দেশ। মজার বিষয় হলো আমরা যারা সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুসলিম তারা বিষয়টিকে দোয়া কালামের উপর ছেড়ে দিয়ে আর হালে এর সাথে একটা জ্বালাময়ী(সাথে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের কিছু উদ্ধৃতিযুক্ত করে) পোস্ট দিয়েই(বেশিরভাগই ইসরাইল ও আমেরিকাকে গালি দিয়ে) ক্ষান্ত হই, ভাবটা এমন যেন আমার এই স্ট্যাটাস সাধারণ কোন পোস্ট নয়, একেকটা লিটলবয়, ফ্যাটম্যান যেন। পোস্ট করার সাথে সাথেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গুড়িয়ে দেবে, হোয়াইট হাউস উড়িয়ে দেবে টাইপ আর কি!! অথচ অনেকে খবরই রাখে না এই নিরীহ প্যালেস্টাইনিদের জীবনের উপর, রক্তের উপর দাড়িয়ে কি নোংরা রাজনৈতিক খেলায় মেতে আছে আরবের পীরসাহেবেরা।

১৫ই মে ১৯৪৮ এ কোন পুর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এমনকি আগেরদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করার মতো কঠিন একটা ঘোষণা দেয়া ইসরায়েলের শক্তির গভীরতা সম্পর্কে কোন পূর্বানুমান ছাড়াই আরবদের সম্মিলিত আক্রমণই ফিলিস্তিনিদের জীবনে কালো ছায়া নামিয়ে আনার জন্য দায়ী। রাজনীতিতে আলোচনা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী তা আরবেরা কখনোই বুঝতে শিখবে বলে মনে হয় না। গামাল আবদেল নাসের (ওই যুদ্ধে একজন মিশরীয় সেনা কর্মকর্তা) ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা আইজ্যাক রবিনের সাথে যোগসাজশে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার চেষ্টায় সফল হোন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে মিশরের প্রেসিডেন্টও হোন। একটা সময় সুয়েজ খাল প্রশ্নে মিশরের নায়ক হয়ে উঠা নাসের ফিলিস্তিন বিষয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে ফিলিস্তিনের মানুষের কপালে দুর্ভোগ বাড়িয়ে গিয়েছেন। মুলত মোটাদাগে মিশর, জর্ডান আর সিরিয়ার মাথামোটা প্রশাসনই বারবার আগ বাড়িয়ে ইসরায়েলের উপর হামলা চালিয়েছে আর মারা খেয়ে পিছু হটেছে অনেক ক্ষয়ক্ষতি মাথায় নিয়ে আর সেই সাথে ফিলিস্তিনের উপর চাপিয়ে দিয়ে এসেছে প্রায়শ্চিত্তের ভার।

গামাল নাসেরের গামলা মাথায় আইজ্যাক রবিন ৫৬-তে যে হামলা করেছে তার ফলশ্রুতিতে উনি পদত্যাগ করলে জনগনের অনুরোধে ফিরে আসলেও পরাজয়ের ধাক্কায় বেশিদিন আর বেঁচে থাকতে পারেন নি। আর ৭৮’এ আনোয়ার সাদাত তো ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করে নিজেদের আখের আর নিজের নামে একটা নোবেল বগলদাবা করলেন। সিরিয়ার হাফিজ আর তার বেটা আসাদ এই বাপ-বেটা মিলে নিজেদের নায়ক বানানোর শ্যুটিং করতেন ফিলিস্তিনে। জর্দান নদীর পূর্ব তীরের বাদশাহ(সাবেক ট্রান্স জর্দান, হালে জর্দান) তার বাদশাহী হাউশ মেটাতেন জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের এক কালের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অফ পালেস্টাইনের প্রতি নিজেদের কৃতজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে। দুর্ভাগ্য যে প্রত্যক দেশের এসব কুকর্মের ফল দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করতে হচ্ছে ফিলিস্তিনের মানুষের। অবস্থাদৃষ্টে এটা স্পষ্ট যে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েল সমর্থক দেশের পাশাপাশি ফিলিস্তিন সমর্থক আরব দেশগুলোও লাভবান হচ্ছে, আরবের আমিরদের ক্ষমতার দৈর্ঘ বাড়ছে, নির্বিবাদে আকাম-কুকাম করে যাচ্ছে নিজ দেশে, এমনকি বিদেশেও। এই খেলায় দুই পক্ষের সবাই-ই লাভের গুড় খাচ্ছে আর ফিলিস্তিন খাচ্ছে পিপড়ের কামড়।

আল আকসা জামে মসজিদ

ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে ভাগ করো শাসন করো নীতির সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলো দুইটা ভিন্নধর্মের অনুসারীদের মধ্যে। এটা অনেক সহজ ছিলো, বৈশিষ্ট্যগত ও আচরণগত কারণেই পৃথিবীর সব ধর্মের অনুসারীরা কোন না কোনভাবেই পরস্পরবিরোধী হয়ে থাকে। উপমহাদেশেও এই সেন্টিমেন্টাল বিরোধটা কাজে লাগিয়েছে এবং সফল হয়েছে। কিন্তু আরবে? এখানে কিভাবে প্রায় একই নীতি প্রয়োগ ও তার সফল বাস্তবায়ন হলো? কিভাবে উপসাগরীয় দেশগুলো ও অন্যান্য আরবদেশগুলোর মধ্যে একই ভাষাভাষী ও একই ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও তারা বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে বলয় সৃষ্টি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করার নেশা পেয়ে গেলো? তাও একসময় যারা একই সাথে জোট বেধে ইসরায়েলের মোকাবেলা করলেও এখন কেন এরা ‘যার যার, তার তার’ নীতিকে আঁকড়ে ধরছে। ওআইসি এখন বাৎসরিক সভা করা আর চক্রাকারে সভাপতি বদল ছাড়া তেমন কিছু করছে? (এদেশে চাকুরী প্রত্যাশী বেকারদের অবশ্য কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ, পরীক্ষায় এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন হয় কি না!!) আর জিসিসি নামক আরেক অকালকুষ্মাণ্ড তো সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধ তৈরি ছাড়া তেমনকিছুই করতে দেখলাম না।

আরব মিডিয়া? আরব নিয়ে, বিশেষ করে প্যালেস্টাইন নিয়ে মিডিয়ার দ্বিচারিতা সবসময় ছুবান কাকুদের পক্ষই নেয়, প্রত্যক্ষে কিংবা পরোক্ষে। ভাবা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সাংবাদিকতায় হলুদ রঙ আরো কড়া আর কটকটে হলুদে পরিণত হচ্ছে। এক গোয়েবলস মারা গিয়েছেন কিন্তু উনার ভূতের জেরোক্স কপি মিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মিডিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ঘটনারা উল্টে যাচ্ছে, লাশের পরিমাণ বাড়লেও সংখ্যা কমে যাচ্ছে, বোমা হামলাও চেহারা পাল্টে হয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীর মলম হামলায়। এতোসব হিপোক্রেসি হচ্ছে এই সভ্য সমাজে, এই আধুনিক ও অবাধ তথ্যসাগরের সময়ে এসে মিডিয়ার এসব ‘হলুদিয়া পাখি’ দেখে যার যার সেন্টিমেন্ট অনুযায়ী রিয়েক্ট করেই চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে থাকি চায়ের আশায়। আমেরিকায় কালো একজনকে পুলিশে মেরে ফেললে হ্যাশট্যাগ হয় ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার বলে, খেয়া নৌকা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, সিনেমা হয়ে চার্টার্ড জেট পর্যন্ত ছেয়ে যায় বিভিন্ন মানবিক বাণী সম্বলিত প্রচারযন্ত্রে। কিন্তু প্যালেস্টাইন নিয়ে কোন হ্যাশও নাই, ট্যাগও নাই, যা আছে তাহলো নিষ্ঠুর প্রহসন। এমনকি ইসরায়েলের বোমায় শত মানুষ মারা গেলেও হামাসের রকেট লঞ্চার নামক আতশবাজি ফোটানো নিয়েই সবাইকে বেশি সোচ্চার আর উচ্চকণ্ঠ হতে দেখা যায়। অসহায় মানুষদের জীবন গেলেই কি বা থাকলেই কি।

আচ্ছা, ফিলিস্তিনিরা কি আজ ঈদের জামাত আদায় করেছে? সদ্য ছেলেহারা ফিলিস্তিনি মা কি সকালে নামাজে পাঠানোর জন্য তার কিশোর ছেলেকে ডাকতে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন নি? কিংবা সদ্য স্বামী হারানো বোনটি ফিরনি রান্না করতে গিয়ে প্রিয় মানুষটিকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ঈদের জামাতে পাঠানোর সর্বশেষ স্মৃতি মনে করে নিজের মধ্যে চুলার আগুনের চেয়েও তীব্র আগুন যন্ত্রণা বোধ করছেন না? এটা কোন দুর্ঘটনা নয়, স্রেফ সন্ত্রাস। জেনে-বুঝে, ঠান্ডা মাথায়, সুস্থ মস্তিষ্কে, চরম অসুস্থ ইসরায়েলের সরকার যা করছে আমি বিশ্বাস করি ইসরায়েলি সাধারণ ইহুদীরাও তা সমর্থন করছে না, করবে না। ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করার জন্য আপনাকে আমাকে মুসলিম হবার দরকার নেই, ইসরায়েলি নেতৃত্বকে ঘৃণা করতে হলে আপনাকে আমাকে হিটলার হতে হবে না, মানুষ হলেই এটা করতে হবে আমাদের।
যারা আল আকসার চিন্তায় ইসরায়েলের ধ্বংস কামনা করছেন তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি, আবরাহা নামক কোন গোয়ারের হাত থেকে বায়তুল্লাহ(আল্লাহর ঘর)কে আল্লাহ নিজেই রক্ষা করেছিলেন, সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। আর হ্যা, ইহুদিদের সমালোচনা বা তাদের ধ্বংসের জন্য দোয়া করার পূর্বে দোয়া করুন তাদের জন্য যারা নিজেদেরকে শিয়া, সুন্নি, আহলে হাদীস, ওহাবী, আহমদিয়াসহ বিভিন্ন কাল্টে বিভক্ত করে নিজেদের দুর্বল করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত তারা যেন মুসলিম হতে পারে। তা না হলে আমাদের দেশের কাষ্ঠল জুব্বাওয়ালাদের মতো গলা দিয়ে হাজার রকম বোমা মেরেই ফিলস্তিনিদের বাঁচাতে হবে, আল কুদস রক্ষা করতে হবে। সমস্যা হলো ওইসব গলাবোমা সদ্য মা হওয়া মেয়েটার ঘুম নষ্ট করা, আর হৃদরোগে আক্রান্ত বয়স্ক লোকটির পালপিটেশন বাড়ানো, পাবলিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে যাওয়া ছোট ভাইটি কিংবা বোনটির মনোযোগ নষ্ট করার পাশাপাশি সামনে বসা তৌহিদীদের হাসানো কিংবা আবেগে ভাসানো ছাড়া কোন কাজে আসে বলে আমার হিসাবে ধরা পড়ে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *