তুর্কি নাচন


ইস্তাম্বুলের রাস্তা দিয়ে হাটতেছি আর ডানে বামে চোখ ঘুরিয়ে দেখছি তুর্কী সাম্রাজ্যের কতশত স্বাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। দেখি আর অবাক হই। মূলত তুর্কি নাচন শব্দটার প্রতি আমার একটা তুমুল আকর্ষণ রয়েছে। এই শব্দটার সাথে যার ভাব হয়েছে ধরে নেবেন উনি নাজেহাল অবস্থায় আছেন। আমিও বেশি বেহালভাবেই নাজেহাল অবস্থা পার করছি। হাটতে হাটতেই অদুরেই দেখতে পেলাম নাদুসনুদুস একটা পরিচিত মুখ। স্বদেশী মনে হচ্ছে। মুখভঙ্গিতে একটা স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ নিয়ে হাতে একটা চুরুট সাহেবী ভঙ্গিতে ধরে হাটছেন। কাছাকাছি আসতেই নধর কপোল আর উজ্জ্বল ফর্সা চামড়া দেখে চিনতে আর অসুবিধা হলো না। স্বদেশী তো বটেই, এক্কেবারে আমার সিলেটি আদমী আমার চর্মচক্ষুর সম্মুখে। আমি আপ্লুত হয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম আরে সৈয়দ সাহেব যে, কেমন আছেন? উনি ভুরু কুচকালেন, নাকের অবস্থান এমনভাবে পরিবর্তন করলেন যেন মিরাবাজারের সিটি করপোরেশনের ভাগাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। বুঝতে পারলাম চোস্ত বাংলায় কাজ হবে না, সোজা নাগরীতে উঠতে হবে। সিলেটি টান দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করতেই উনার ভুরু কপালে উঠার যোগাড়। আমি বুঝতে পারলাম, মানুষ বড় হলে এমনই হয়, এটাই হবার কথা। হতাশ হয়ে রাস্তা দেবার সময় উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অবা ম্যাচ অইবো নি তোমার টাইন?’ আমি এখন পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গেলাম, ভাবলাম সিগারেটটা না ছাড়লে অন্তত বিড়িতো বন্ধুত্বটা পাতানো যেতো। কিন্তু না, বিধি ডানে তো নেই-ই বামেও নেই। আমি চোখেমুখে চুড়ান্ত রকম হতাশা এনে বললাম “জ্বি না চাচা, বিড়ি খাওয়া তো ছাড়িচ্চি”, শুনেই উনার চোয়াল ঝুলে গেলো। উনি আমার চেয়েও গভীর ডিপ্রেশনে চলে গেলেন মনে হচ্ছে। আমি তাই দেখে বললাম, ‘অবা-চ্চা, বাক্কা বয়স অইছে বা, এবলা ইতা খাওয়া ছাড়ইন!’ বুঝতে পারলাম দৃষ্টিতে মা কালীর দিব্যরথ থাকলে আমি ভুষা কয়লার মতো ছাই হয়ে যেতাম।

উনি তখন আক্ষেপ করে বললেন, এক ‘চিনি চাচার চৌরি’ গল্প লিখে পাইকারি চাচা হয়ে গেলাম। বাপ-ছেলে সবাই এখন আমারে চাচা ডাকে। বেত্তমিজ ‘ঝান্ডুদা’র পাল্লায় পড়ে রাগে তাকে নিয়ে আরেকটা গল্প লিখেছিলাম তাকে অপমানিত চরিত্রে রেখে, অথচ দেখো ঝান্ডুদা বিখ্যাত হলো পরিব্রাজক হিসেবে আর আমি চাচা চাচাই রইলাম। উনার এহেন আক্ষেপ শুনে কিছুটা সুযোগ পাওয়া গেলো মনে করে বললাম ভাইয়া চলেন কোথাও বসে চা খেতে খেতে গল্প করি আর হাতে থাকা সিগারেটটার উপযোগও নিলেন। ভেবেছিলাম ভাইয়া ডাক শুনলে উনার চিত্ত বিগলিত হবে। কিন্তু কপালে আমার বাঁশঝাড় থাকায় উনি আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করে বললেন অবস্থা বেহাল হলে টাখনুর বয়সী পোলাপানও ভাইয়া বলে মশকরা করে, এরপর আমার দিকে তাকিয়ে অনুরোধের ভঙ্গি করে বলেন, ‘বাবারে আল্লার ওয়াস্তে আমারে একটু আংকেল কইয়া মাতাইস, ইগু বিদেশ বেটা ইখানো চাচা কইলে কিলান লাগে না নি, ক ছাইন?’

কথাটা শুনেই মনে হলো এই মুহুর্তে আমি একটা মেনটস চকোলেট মুখে নিয়েছি আর সাথে সাথেই আমার মাথা নামক জৈববস্তুর ভাগাড়ে হাজার ওয়াটের বুদ্ধির এলইডি লাইটটা জ্বলে উঠলো, আনন্দিত ভাব জোর করে নাকেমুখে এনে বললাম আমি কিন্তু প্রথমে আপনাকে আংকেলই বলেই ডাকতে চেয়েছিলাম। বেয়াদবি ভাবতে পারেন ভেবে ইংরেজিতে ডাকি নি, আবার তুর্কীরা তাদের চাচাকে কি বলে ডাকে তাও জানি না। এজন্যই চাচা বলে ডেকে ফেলেছি, মাফ করবেন আংকেল। উনি মনে হয় খুশিই হলেন। বললেন চল তোকে আজ আদা দিয়ে লাল চা খাওয়াবো। লাল চায়ের দাওয়াত পেয়ে আনন্দে চোখদুটো আমার ভিজে আসতে লাগলো, কোনরকম চোখদুটোকে শুকনো রাখতে হলো আর কি। এই বিদেশ বিভুইয়ে কেউ একজন দাওয়াত দিয়ে চা খাওয়াচ্ছে ভাবতেই নিজেকে বিরাট ভাগ্যবান বলে মনে হলো। খুজে পেতে একটা চায়ের দোকানে গেলাম, ভাব নিয়ে বললাম ”চাচা, দুই কাপ লাল চা, লগে আদা, আর আমার কাপে থুরা আলগা পাত্তি মারিদেইন যেনো”। কথাটা বলেই জিহবাতে কামড় দিয়ে সৈয়দ সাহেবের দিকে তাকালাম। উনার এই দৃষ্টি আমার পরিচিত, কিছুক্ষণের পরিচয়ে উনার এই অগ্নি দৃষ্টি আমি চিনে ফেলেছি। বুঝতে পেরে চাচার জায়গায় আংকেল বসিয়ে আবারও চায়ের অর্ডার দিলাম।

বসতে যেয়েই দেখি একজন লোক চায়ের মাঝে বনরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছেন। দেখামাত্রই ক্যাম্পাস জীবনের লাল টংয়ের কথা মনে হয়ে গেলো। এভাবেই চায়ে বনরুটি ডুবিয়ে কত খেয়েছি। আহারে জীবন, আহা জীবন!! লোকটার সামনাসামনি গিয়ে বসে উনার খাওয়া দেখতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম কামলা শ্রেনীর মানুষ, সারাদিন পরিশ্রম করে এক থালা ভাত যোগাড় করতে পারে না হয়তো। কিন্তু লোকটাকে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে।  ওসমানী মার্কা গোঁফ সাথে এলোমেলো রুক্ষ চুল। ‘কোথায় যেন দেখেছি’ মার্কা চেহারা লোকটির। আমার হাবভাব দেখে সৈয়দ আংকেল(এখন থেকে আর ভুল হবে না) আমার কানের কাছে এসে মুখ নামিয়ে বলেন, ‘এ বেটা ইগুরে মাতাইছ না, টানা তিন ‘হাল বাতাও (শোকজ)’ খাইয়া ইগুর মাথা মুথা আউলি গ্যাছে, পকেটো রিপোর্টের জবাব লইয়া ঘুরের আর ইতা পাগলামি করের, তুই কান্ধা ভিড়িস না, বেঙ্গাত পড়িযিবে দেখিস’। আমিও কানে কানে আংকেলকে বললাম, উনাকে তো চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কোথায় যেন দেখেছি।

সৈয়দ আংকেল  আমার মুর্খতা দেখে কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে গেলেন, তিনি হতাশার পারদ চড়িয়ে আমাকে বললেন তোমরা সুলতান সাবরে চিনো না নি বেটাইন! আমি আবারো অবাক হলাম, ভাবলাম “সুলতান সাহেব??” মানে মঈনুস সুলতান চাচা, উনার আবার কি হলো? আহারে বেচারা!! কতদেশ ঘুরে বেড়ালেন, কতদেশে চাকরি করলেন, শেষমেষ তুর্কী সাম্রাজ্যে এসে কি না তুর্কিনাচনে পড়ে গেলেন!! আমি মনোযোগ দিয়ে বনরুটি খাওয়ায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃশ্যটি দেখছি আর ভাবছি কি ক্ষ্যামতা এই ‘হাল বাতাও’ নোটিশের। উনি হাতের বনরুটি শেষ করে শার্টের উপর পড়ে থাকা গুড়ো গুলো জমিয়ে চমৎকার কৌশলে হাতের তালুতে নিয়ে মুখে চালান করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমার তো তখন বিনা লাফে আসমানে উঠার যোগাড়। আমিও উসাইন বোল্টিয় গতিতে আমার ডানহাত উনার হাতে লাগিয়ে হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য চেপে ধরেই বুঝতে পারলাম এটা উনার বামহাত ছিলো। ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই নিজের বলদ মার্কা উত্তেজনার কথা মনে পড়তেই নিজেকে ধিক্কার দিতে শুরু করলাম। ওদিকে সুলতান সাহেব তো রেগেই টং!!

আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন ‘যারে বেটা মুখেদি বাক্কা সাবুদ একটা গালি আইছিল, দিলাম না। দুই টেখার চা বেছড়া অইয়া তুই আমার লগে আত মিলাইতে খরি আত বাড়াইদিলে কিলান!!’ এই কথা শুনে এতোটাই অপমানিত বোধ করছিলাম যে আমার অপমান সহ্য করতে না পেরে স্বয়ং রবিঠাকুর এসে ভর করলেন আমার ঘাড়ে, আমি তখন আপন মনে আবৃত্তি করতে শুরু করলাম, ‘তুমি মহারাজ, বনরুটি খেলে আজ, হাজার বনরুটি চালান দিয়েছি পেটে’। উনি এটা শুনে শুধু বললেন ‘ এ বেটা, কিতা কইলে? আবার ক ছাইন’। আরো কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় চা-দোকানি উনার হাতে এক গ্লাস পানি তুলে দিতেই উনি তা পান করতে লাগেন আর আমিও বেচে যাই উনার মুখনিঃসৃত আদি, আসল ও অকৃত্রিম নাগরী গালাগাল থেকে। পানি খেয়েই উনি সৈয়দ সাহেবের হাত থেকে সিগারেটটি একটানে নিয়ে ঠোঁটের কোনায় চেপে ধরে আগুন ধরিয়ে টানা শুরু করলেন। আসন্ন শ্রীহট্টীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনায় আমার চোখে সারিনদীর রহস্যময় জলের স্রোত টলটল করছিলো। এদিকে সৈয়দ সাহেবের অফার করা চা-ও ঠান্ডা হয়ে চারবত হয়ে গেছে। সৈয়দ সাহেব এমনিতেই নাদুসনুদুস, ফর্সা ব্যক্তি। চোখের সামনের গনগনে গরম পানিতে পড়া ব্যাঙের মতো উনাকে ফুলতে দেখছি আর সেই সাথে উনার গালে জমতে লাগলো জাফরানি আলতা। একবার ভাবলাম পালাবো নাকি? পরে মনে হলো স্বজাতির কিছু করা উচিত। কি করা উচিত ভাবতেছি, ভাবতেছি তো ভাবতেছিই। আপনারাও ভাবুন, ভাবতে থাকুন, কি করা যায় স্বজাতির জন্য সেটা ভাবতে থাকুন।
-কিছু পেয়েছেন কী?
-পান নি?-নো প্রবলেম, আমি কিন্তু দাওয়াই পেয়ে গিয়েছি, একদম অব্যর্থ দাওয়াই। অপেক্ষা শুধু দাঙ্গাটা কখন জমাট বেধে পায়েস হবে আর তখনি আমি আয়েশ করে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই শ্রীপুরের সেই বিখ্যাত ‘বড়ি’র মতো টুপুস করে গলিয়ে দেবো, ব্যস। এদিকে সৈয়দ সাহেব আর সুলতান সাহেব ইতোমধ্যে হাতা গুটিয়ে নিয়েছেন, যেই একজন আরেকজনের কলার ধরতে যাবে অমনি আমি চায়ের কাপে শাহী চুমুকটা ঢক করে চালান দিয়েই লাফ দিয়ে উঠে বললাম “চাচারে বো দৌড় দেও, ছুবে দৌড় লাগাও, অউ দেখো দুইও চাচী আইরো, আতো লাগের বেন্দার লাখান কিতা দেখা যাইরো” এরপর যে কি হলো মুহুর্তের মধ্যে। যাক সে কথা পড়ে বলবো নে।

আপাতত পত্রিকা পড়ছি, গতকালের পত্রিকা, পাতা খুলতেই বিশাল নিউজ। গোটা ও মোটা হরফে লিখে দিয়েছে “৮০% আমার গোত্রীয় বনি আদমেরা তাহাদের উত্তম অর্ধ দ্বারা মানসিক আপ্যায়ন লাভ করে” আমি পুরো রিপোর্টটা শেষ করেও আমার খটকা দুর করতে পারলাম না। ব্যাপারটা কি বুঝতেছি না আসলে। বাকি ২০% কই গেলো? এখনো তো শারিরীক, শারিরীক ও মানসিক প্রোটিন জাতীয় আপ্যায়ন বাকিই রয়ে গেলো!! আমি মাথা তুলে তাকালাম, তাকাতেই দেখলাম একজন মহিলা মানুষ(!!)আমার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রথমে চিনতে পারি নি। কে হতে পারে, কে হতে পারে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো উনি আমার একমাত্র মেয়ের একমাত্র মা! আমি আবারো রিপোর্টে চোখ বুলালাম, আর বিড়বিড় করে বললাম বাকি ২০% আসলে কারা? তারা কই গেলো?

পুনশ্চঃ১# স্থান, কাল, পাত্র নিয়ে চিন্তা না করে বাকি ২০% কই গেলো সেটা খুজে বের করুন।
পুনশ্চঃ২# রিপোর্ট পড়ার সময় ও পোস্ট লেখার সময় আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের “সিঙ্গুলার এনটিটি” অনুভব করেছিলাম!!


২০/১১/২০২০ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *