ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা, আর্জেন্টিনার ফুটবল ইশ্বর? নাকি ফুটবলের ইতিহাসে নিজেকে ইশ্বরের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা এক অসামান্য ফুটবলার? বুয়েন্স আয়ার্সের লানুস শহরে জন্ম নেয়া ম্যারাডোনার শুরুটা হয়েছিলো বলবয় হিসেবে। এতে করে ফুটবলের প্রতি ভালবাসাময় আনন্দের পাশাপাশি সামান্য অর্থও মিলতো। বলা যায় অর্থের খোঁজেই বনে গেলেন ফুটবলার। ১৯৬৮ সালে এসত্রেয়া রোজার হয়ে শুরু। এরপর সিনিয়র দলে ম্যারাডোনার যাত্রা শুরু আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে। ঠিক এক দশক পরে ১৯৭৭ সালে খুলে যায় জাতীয় দলের দরজা। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আর্জেন্টিনার জার্সিতে অভিষেক হলো ফুটবল পায়ে দর্শকের চোখে মায়াঞ্জন এঁকে দেয়া ম্যারাডোনার। ১৯৭৯ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে ১৮ বছর বয়সে ফিফা অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে অংশ নেন। ফাইনালে শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। যুব বিশ্বকাপের সেই আসরে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে সবার নজর কেরে নেন ম্যারাডোনা।
১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার মূল দলের হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নামেন ম্যারাডোনা। তবে, খুব বেশি আলো ছড়াতে পারেননি। ব্রাজিলের সঙ্গে লাল কার্ড দেখেন ম্যারাডোনা আর তার দলও দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় নেয়।
চার বছর পর বিশ্বকাপের মঞ্চে আবারো আর্জেন্টিনা। এবার আগের চেয়ে বেশি পরিণত ম্যারাডোনা। মেক্সিকোর সে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই দুর্দান্ত খেলতে থাকে আলবিসেলেস্তেরা। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। দু’দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে সংঘটিত ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণে খেলায় ছড়িয়ে পড়ে বাড়তি উত্তেজনা। ক্ষণে ক্ষনে রং বদলানো ম্যাচের ৫১ মিনিটে শূন্যে লাফিয়ে উঠে হাত দিয়ে গোল করেন ম্যারাডোনা। হেডের ছলে তার হাতের টোকায় করা গোল এতটাই নিখুঁত ছিলো যে মাঠে থাকা রেফারি আলী বিন নাসেরও তা দেখতে পাননি। ইতিহাসে সে গোলেরই পরে নাম দেয়া ‘হ্যান্ড অব গড’। ম্যাচে এরপর আরো একটি গোল করেন ম্যারাডোনা। যা ইতিহাসের গোল অব দ্য সেঞ্চুরি হিসেবে পরিচিত।
সেমিফাইনাল ফাইনাল সব জায়গাতেই ম্যারাডোনা ছিলেন অনন্য। ফাইনালে তো পশ্চিম জার্মানির ফুটবলাররা তাকে শুরু থেকেই কড়া মার্কিংয়ে রাখে। কিন্তু তারপরও তার বাড়িয়ে দেয়া পাসে জয়সূচক গোল করেন বুরুচাগা। ৩-২ গোলের জয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। আসরে আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের ১০টিই অবদান ছিলো ম্যারাডোনার। বিশ্বকাপের আসরে আর কোন খেলোয়াড় একা এতোটা অবদান রাখেন নি কোন দলকে শিরোপা জেতাতে। দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে এই আসরে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার গোল্ডেন বলও জিতে নেন তিনি। উল্লেখ্য যে, এর আগে অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপেও গোল্ডেন বল জিতেছিলেন ম্যারাডোনা।
৮৬ এর বিশ্বকাপ
এই পর্যন্ত যত বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে, তার মাঝে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপেই খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তারকার আবির্ভাব হয়েছিল। ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার; ব্রাজিলের জিকো, সক্রেটিস; ফ্রান্সের প্লাতিনি; জার্মানির রুডি ভয়েলার, লোথার ম্যাথিউস- এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দেশের সর্বকালের সেরা একাদশে অনায়াসে সুযোগ পাবেন। কিন্তু এদের সবাইকে ছাপিয়ে সেবারে জ্বলে ওঠেন ম্যারাডোনা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার ফকল্যান্ডের যুদ্ধ খেলার আবহটাকে ভিন্নরকম করে ফেলে। সেই পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যায় যখন ম্যারাডোনা হাত দিয়ে বল স্পর্শ করার পর সেটি গোল হয়। এই গোলটিই ‘হ্যান্ড অফ গড’ নামে পরিচিত।
তবে এই বিতর্ক তিনি দূর করে ফেলেন মিনিট চারেক পরেই আরেকটি অসাধারণ গোল করে। মাঝমাঠে বল দখলে নেন ম্যারাডোনা, ইংল্যান্ডের গোলপোস্টের দিকে ঘুরে গিয়ে দৌড়ান মাঠের অর্ধেকেরও বেশি অংশ, এভাবে পাঁচ জন ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষককে কাটিয়ে গোল করেন তিনি। আর এই গোলটি গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এরপর সেমিফাইনালে আরো দুটি গোল করে একক কৃতিত্বে ম্যারাডোনা ফাইনালে ওঠান আর্জেন্টিনাকে। ফাইনালে তাকে ডাবল মার্কিংয়ে রাখায় গোল করতে না পারলেও তারই বাড়িয়ে দেওয়া পাসে আর্জেন্টিনার পক্ষে জয়সূচক গোল করেন বুরুচাগা। পুরো টুর্নামেন্টে পাঁচ গোলের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ৫টি অ্যাসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন ম্যারাডোনা। প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের ১০টিতেই ম্যারাডোনার অবদান ছিল। শুধু তা-ই নয় পুরো টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা তাদের প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে যতগুলো শট নিয়েছে, তার অর্ধেকের বেশিই ফুটবলের ইশ্বর বনে যাওয়া ম্যারাডোনার তৈরি করা।
কিন্তু এই পরিসংখ্যান দিয়েও ম্যারাডোনার কৃতিত্ব পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। সেটা বোঝার জন্য আরো কিছু তথ্য দেওয়া জরুরি।
প্রতিটি বিশ্বকাপ শেষেই বিশ্বকাপ কর্তৃপক্ষ ‘অলস্টার টিম’ নামে একটি একাদশ প্রকাশ করা হয়। বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করা খেলোয়াড়দের নিয়ে এই একাদশ গঠন করা হয়। মোটামুটিভাবে বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট দল থেকেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় সুযোগ পায়। এর মাঝে আবার স্বাভাবিকভাবে চ্যাম্পিয়ন দল থেকেই বেশি সদস্য সুযোগ পায়। ব্যতিক্রম ছিল ১৯৮৬ সালে। সে বছর যে একাদশ প্রকাশ করা হয়, তাতে চ্যাম্পিয়ন দল থেকে একজন সুযোগ পায় এবং তিনি ম্যারাডোনা।
এই প্রবন্ধে ম্যারাডোনাকে নিয়ে শুধু তার জাতীয় দলের কিছু বিশেষ অবদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর ক্লাব ক্যারিয়ার নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ভালো থাকুন, সারমর্মের পাশে থাকুন।